‘জায়গাটার নাম ম্যাজিক’
আমি এখানে রোজ আসি। ঘন্টা দেড়েক সময় নিয়ে আরও একবার নতুন করে আলাপ জমাই বাকি প্রতিবেশীদের সঙ্গে। আমি বুঝি ওরাও অপেক্ষায় থাকে আমার। আমি এসে বসার সঙ্গে সঙ্গে কাছে কাছে এগিয়ে হাত ছুঁয়ে যায়। আমার শরীরের ঢাকা, আ-ঢাকা চামড়ায় এঁকে যায় অদৃশ্য সব নকশা। মাথার চারদিকে ঘুরপাক খেতে খেতে বলে যায় জমে যাওয়া কিছু অসমাপ্ত গল্প। ঠিক যখন আমাদের আলাপ আলোচনা দিনলগ্নের শেষ চৌকাঠে পা রাখবে রাখবে মনে করে, আমি কাঁপা কাঁপা হাতের কৌটোটা থেকে তেল ঢালি পুড়ে ওঠা প্রদীপের থলে অংশটায়। পকেট থেকে বের করি গোল পাকানো একটা তুলোর ডেলা। আর তারপর? ঠাস করে হাতের আড়ালে দেশলাই বাক্সের গায়ে কাঠি ঘষে জ্বালিয়ে দিই সেই প্রদীপটা। মনে পড়ে যায় মা গোটা হেমন্তকাল জুড়েই এরকমই একটা ছোট আলো জ্বালিয়ে রাখত বারান্দায়। আকাশপ্ৰদীপ। হেমন্তকালে নাকি পূর্বপুরুষেরা আশমান থেকে মাটিতে নামে। অন্ধকার সন্ধ্যায় তাদের আলো দরকার পড়ে। আমাদের এই শহরটারও কি পূর্বপুরুষ আছে? তারাও কি নেমে দাঁড়ায় উত্তরপুরুষের শহর দেখতে?
হালকা একটা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। ক্রমশঃ সন্ধে নেমে আসছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডানার শব্দটা ছাড়া আর একটাও শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। না পাওয়ারই কথা। কারণ এই অবসিত বেলায়, নির্জনতায়, গাছপালা ঘেরা উপত্যকায় একমাত্র জীবিত প্রাণী যে আমি। আমি রোহিত। সম্পূর্ণ অনাহুত।
প্রদীপটাকে গুছিয়ে লতাপাতার আড়ালে রাখতে না রাখতেই আচমকা উল্টোদিক থেকে একটা টান অনুভব করি। মনের ভুল। অগ্রাহ্য করে আবার নিজের কাজে মন দিই। হাওয়াটা বেড়েই চলেছে। প্রদীপের আলোটা ওর হলুদ আভাকে টিকিয়ে রাখতে পারছে না। কমে আসছে ম্যারম্যারে আলোর দীপ্তি। হাত ছেড়ে এবার নিজের পুরো শরীরটাকে ঢাল করে যতটা সম্ভব আলোটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি। অন্ততঃ ও বাঁচুক। আমার অস্তিত্ব এখানে থাকা অবধি ও বাঁচুক। আবার একটা টান। আহঃ। কে ও? যতবার শরীরটাকে ভাঁজ করে উবু হয়ে বসতে যাচ্ছি। ততবারই বিপরীত টানটা আমাকে বাধা দিচ্ছে। বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকাতেই কে যেন বলে ওঠে,
‘তুমি ম্যাজিক জানো?’
আমি হন্যে হয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘোরাচ্ছিলাম। বুঝতে চেষ্টা করছিলাম কে বলল কথা? কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। শিরশিরে হাওয়ায় মাথা দোলানো গুল্ম ঝোপঝাড় ছাড়া সত্যি সত্যি আর কেউ তো ছিলও না আমার চারপাশে। আর কারুর থাকার তো কথাও নয়। আকাচা জামাটা ভিজে চুপচুপে হয়ে সেঁটে গেছিল আমার পিঠের সঙ্গে। কপালে বিলবিলে হয়ে জেগে উঠেছিল বিন্দু বিন্দু ঘাম। আর ঠিক তখনই আমাকে আরও খানিকটা অবাক করে দিয়ে সেই মানুষের গলার স্বরটা দ্বিতীয়বার বলে ওঠে,
‘তুমি ম্যাজিক জানো? সত্যি সত্যি তুমি ম্যাজিক জানো?’
একটা নয়। একইসঙ্গে দু’দুটো বাক্য বলা মিষ্টি গলার আওয়াজটা সে জায়গার নিস্তব্ধতাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল মুহূর্তে। আমি সম্মোহিতের মত দাঁড়িয়েছিলাম। আমার কাছে অতীত, বর্তমান তালগোল পাকিয়ে নিমেষের মধ্যে এক হয়ে গেছিল। আর আমার ঠোঁট নিতান্ত বোকা মানুষের মত বলতে শুরু করেছিল,
‘জানি বৈকি। ম্যাজিক তো সব্বাই দেখাতে পারে না। কেউ কেউ পারে। তাই বলে ভেবো না এ বড় কঠিন কাজ। সত্যিকারের ম্যাজিক হল ধোঁয়া। যখন তুমি সে ধোঁয়ার নাম-নিশান বুঝতে পারবে না। তখন বুঝবে তোমার সামনে একটা জাদুকর এসেছে বটে। আর সেরা জাদুকরের কাজ কি জানো? তোমার সামনে থেকে সব যুক্তিকে, সব বাস্তবকে, এক টুসকিতে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া... এই ... এইভাবে...’ কেন জানি না নিজের অজ্ঞাতেই মুখের হাঁ-টা খুলে গেছিল। ঠিক... ঠিক ... তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের মত করেই। আমি হয়ত আরও বুরবাক আরও বুদ্ধু হয়ে আরও খানিকটা সময় না বুঝে কথোপকথন চালিয়েই যেতাম। হয়ত কেন চালিয়ে যেতামই। তাতে আমার কি হত, বর্তমান অবস্থার থেকে আমার তেমন উন্নতি হত কি অবনতি হত তাও বলতে পারব না। তবে একথাটা জোরের সঙ্গে বলতে পারি স্নায়ুর চাপ যখন প্রতি সেকেন্ডে স্বাভাবিকের থেকে দ্বিগুণ মাত্রা নিচ্ছিল ঠিক সেই সময়েই আমার পায়ের ওপর দিয়ে অসম্ভব দ্রুততায় চলে গেছিল একটা হিমশীতল সরীসৃপ। আমি ভয়ানক ভয়ে লাফিয়ে উঠে নিজের অসুস্থ শরীরটাকে নিয়ে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেছিলাম কাঁটা ঝোপঝাড়ের মধ্যেই। তারপর...
**
চোখের সামনে যেন হাজারটা বাল্ব একসঙ্গে জ্বলে উঠেছিল। হলের মধ্যের প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক একসঙ্গে হাততালি দিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সরে গেছিল কালো লম্বা পর্দাটা। ঝলমলিয়ে উঠেছিল চারদিক। একসঙ্গে অত আলো, আর কান ফাটানো অর্কেস্ট্রার তুমুল দাপাদাপিতে মনে হচ্ছিল আমি পৃথিবী না পৃথিবীর মতই দেখতে একটা অন্য গ্রহে চলে এসেছি। এত মানুষ, এত আলো, এত শব্দ, তার ওপর স্টেজের ঘুরে বেড়ানো ঝলমলে পোষাকের মানুষজন আমার চোখে ধাঁধাঁ লাগিয়ে দিয়েছিল। সেই তখন থেকে স্টেজের বাহারি অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার আর ইহজগত সম্পর্কে কোনও হুঁশ-ই ছিল না। আর ঠিক এই সুযোগেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্বল দিক। বিধাতা যেন এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। সন্তর্পণে কখন যে শয়তান তার ফন্দি এঁটে রেখেছিল জানতেই পারিনি।
বুঝতে পারি স্টেজের ওই মখমল পর্দা আবার দুপিঠ পরস্পর জুড়ে গেলে। কান ঝালাপালা করে শো- শেষের ঘন্টা বেজে উঠতেই টনক নড়ে আমার। পাগলের মত এদিক ওদিক খুঁজতে থাকি। হলের ভেতরে,বাইরে এসে দৌড়ে দৌড়ে কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলে যখন সঙ্গে আসা অভিভাবককে কাছে পাওয়ার সমস্ত আশা পরিত্যাগ করেছি। তখনই কোনও এক স্বপ্নলোকের দুনিয়া থেকে আমার সামনে আনটপকা এসে দাঁড়িয়েছিল একটা ছ’ফুট উচ্চতার দোহারা চেহারার মানুষ। আর আমার কান্নাভেজা গলা থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এসেছিল,
‘তুমি ম্যাজিক জানো?’
কারণ ওই মানুষটার দিকেই আমি এতক্ষণ চোখের পলক না ফেলে বুদ্ধুর মত তাকিয়েছিলাম। হ্যাঁ বয়স আমার ছয়-সাত হলেও লোকটির চেহারার ঢেঙ্গা গড়ণটার জন্য আমার এতটুকু বুঝতে দেরি হয়নি যে, এই হচ্ছে স্টেজের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যমণি মানুষটি। যাকে আপাত দৃষ্টিতে আমরা যেকেউ ম্যাজিশিয়ান বলেই ডাকি। লোকটা ওর চেহারা খানিকটা ঝুঁকিয়েই আমার কাছাকাছি এসে উবু হয়ে বসে বলেছিল,
‘জানি বৈকি। ম্যাজিক তো সব্বাই দেখাতে পারে না। কেউ কেউ পারে। তাই বলে ভেবো না এ বড় কঠিন কাজ। সত্যিকারের ম্যাজিক হল ধোঁয়া। যখন তুমি সে ধোঁয়ার নাম-নিশান বুঝতে পারবে না। তখন বুঝবে তোমার সামনে একটা জাদুকর এসেছে বটে। আর সেরা জাদুকরের কাজ কি জানো? তোমার সামনে থেকে সব যুক্তিকে, সব বাস্তবকে, এক টুসকিতে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া... এই ... এইভাবে...’ লোকটা মুখ হাঁ করে আরও কিছু দেখাতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই আমি হাউ হাউ করে কেঁদে জড়িয়ে ধরেছিলাম সম্পূর্ণ অপরিচিত সেই লোকটাকে। যাঁকে পোস্টারের ছবি অনুযায়ী সবাই ‘প্রিন্স শীল’ বলেই চেনে। আর ম্যাজিকপ্রেমী এমন কোনো মানুষ নেই যিনি তাঁর এই ‘বুলেট ক্যাচিং’ শোয়ের সঙ্গে পরিচিত নন। স্টেজে ভয়ানক রাইফেলের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে পরক্ষণেই মুখের লুকানো কোণ থেকে যেভাবে বের করে এনেছিলেন জলজ্যান্ত সেই বুলেটখানা। যেটা নাকি কিছুক্ষণ আগেই তিনি পুরে দিয়েছিলেন রাইফেলে (চিহ্ন সমেত), মনে হয়েছিল আমার মামাকেও হয়ত বা তিনি তেমন ম্যাজিক করেই ফিরিয়ে আনবেন। হ্যাঁ...হ্যাঁ... হ্যাঁ মামার সঙ্গেই আমি ‘প্রিন্স শীলের ম্যাজিক শো’ দেখতে গেছিলাম। কিন্তু... মামা... মামা... যে কোথায় হারিয়ে গেছিল। বাবা মারা পর যে পৃথিবীটা আমার মা আর মামা ছাড়া নিকষ কালো একটা শয়তানে পরিণত হয়েছিল। যে মামা আমাকে নিজের হাতে আলুসেদ্ধ মেখে ভাত খাইয়ে দিত প্রতিদিন। যে মামা আমাকে পাশে নিয়ে না শুলে ঘুমই আসত না। তিনি এই জনসমুদ্রে, এই বিষ পৃথিবীর বুকে আমাকে একা রেখে কোথায় গেল?
**
বিশ্বাস করতে অসুবিধা হলেও এটা একেবারে বাস্তব সত্যি। মামা সেদিন আমাকে ছেড়ে রেখে চলে গেছিলেন। সেই বয়সে তার কারণ বুঝতে না পারলেও আজ কিছু কিছু বুঝি। হয়ত বা আমার বাবার সম্পত্তি! যার একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিলাম আমি। তার জন্যই... কিন্তু মা? তিনি কিকরে তাঁর সন্তানকে নিজের থেকে আলাদা করতে পারলেন? তবে কি সমস্তটাই মায়ের আড়ালে হয়েছিল? আহঃ কী যন্ত্রণা কী যন্ত্রণা। মামা আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর প্রিন্স শীল আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। নিজের গুমটি ঘরে ডাল ভাত, নুন ভাত খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আত্মিক সম্পর্কের মানুষগুলোর জন্য আমি যেন কিছুতেই তাঁর সামনে সহজ হতে পারছিলাম না। সহজ হতে না পারার আরও একটা কারণও ছিল অবশ্য। লোকটা রাতের বেলা আমার কাছে এসে রোজ চোখের জল মুছিয়ে দিতেন আর বলতেন,
‘কাঁদিস না। কাল সকালে ঠিক তোকে বাড়ি পৌঁছে দেব।‘
আমিও রাত জেগে সেই ভোরের অপেক্ষায় থেকেছি। যেখানে সূর্যের আলোর সঙ্গে মা মা গন্ধটা অদ্ভুতভাবে মিশে। হায় বিধাতা। সে স্বপ্ন হয়েই থেকেছে। মাকেও পাইনি। পাইনি সেই আপন ভোরের সন্ধান। পরিবর্তে প্রিন্স শীলের সঙ্গে অনিচ্ছাসত্ত্বেও জড়িয়ে যেতে শুরু করে জীবনটা। তিনি কি ইচ্ছে করেই আমাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দেননি? কি জানি। অনেকবার... অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম যদি একবার পালাতে পারি। তাহলে আজ নয় কাল ঠিক মাকে খুঁজে বার করবই। বোকা আমি। প্রিন্স শীল সবার চোখে ধোঁয়া দিতে পারলেও তার চোখকে ধোঁয়া দিয়ে সরে যাওয়াটা অতটা সহজ কাজ ছিল না। শেষমেষ ঠিক করি ‘ম্যাজিক’ শিখব। আমাকে যেমন বোকা করেছে মানুষ। আমিও একদিন তাঁদের বোকা বানাব। একটু একটু করে প্রিন্স শীলের কাছে তালিম নিতে শুরু করি। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিই মানুষ ‘ম্যাজিক’ নামের এই একটামাত্র জায়গাতে পয়সা দিয়ে চোখে ধাঁধা লাগাতে আসে। বোকা হতে ভালোবাসে। এই একটিমাত্র জায়গা যেখানে কেউ কাউকে কৈফিয়ত দেয় না।
বেশ ভালই চলছিল। প্রিন্সের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কখন যে আমি রঞ্জন সমাদ্দার থেকে ‘রোহিত শীল’ হয়ে গেছিলাম নিজেই বুঝতে পারিনি। বোঝার মধ্যে যেটুকু বুঝেছিলাম তা হল প্রিন্স শীল সম্ভবত খ্রিস্টান ছিলেন। তাই আমাকে অনেকটা তাঁর ধাঁচে রাখতেই নাম পদবীর পরিবর্তন।
তবে জীবনে কোনও কিছুই স্থায়ী হয় না। মানুষ অনেক বেশি আধুনিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিনা জানি না ‘ম্যাজিক শো’, ‘সার্কাসের শো’ এগুলোর চাহিদা কমতে থাকে। ছোটখাটো স্কুলের শো আর এদিকে ওদিকে দু’একটা ডাকেই কোনওমতে আমাদের দিন গুজরান হচ্ছিল। এই সময়ই ভয়ানক সেই খবরটা আসে। সারা পৃথিবী ভয়ানক এক মারণ রোগে কেঁপে ওঠে। সে মারণ ভাইরাসের নাম কোভিড-১৯। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য এর থেকে রেহাই পায়নি কেউই। গোটা গ্রহ জুড়ে ত্রাহি ত্রাহি রব। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শ ছিন্ন হয়েছে। অদৃশ্য সেই যে একটা মুখোশ মানুষজাতি সম্বল করেছিল। সেটা বাস্তব হয়ে সবার মুখ ঢেকেছে। পারস্পরিক অবিশ্বাস ঘরে ঘরে। মা বাবা মরে গেলেও ছেলেমেয়েরা ছুঁতে আসছে না। উল্টোদিকে সন্তান মারা গেলেও একই দৃশ্য। কিন্তু প্রিন্স যে সবার মাঝেই ‘প্রিন্স’ খেতাব পেয়েছিলেন। তার কি লুকিয়ে থাকা সাজে? যে সময়ের কথা বলছি সেসময় ভাইরাসের খবরটা অতটা চাউর হয়নি। ‘প্রিন্স কোনও এক বইমেলায় শো করে এসে হটাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জ্বর, ঘুষঘুষে কাশি। ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু তারপরেই দুর্যোগের কালো মেঘ নেমে আসে আমাদের গুমটিতে। এক রাতে প্রিন্সের আচমকা শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। মাত্র দু’চার সেকেন্ড। প্রিন্স আমাকে ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে কষ্টে বুক ডলতে ডলতে বলেছিল,
‘দেখিস আমি ম্যাজিক করে আবার সব ঠিক করে দেব। তুই আবার শো করতে পারবি।‘
কেটে গেছে দু’দুটো বছর। যে ভাইরাস ২০২০নাগাদ কব্জা করেছিল পৃথিবীকে। ২০২২এও তার ভয়াবহতা কিছুমাত্র কমেনি। গুমটির আশেপাশের অধিকাংশ মানুষ জীবন হারিয়েছে। যে কয়টা জীবন আছে তারাও মৃত্যুভয়ে কাতর। একা আমি রোহিত তাও স্বপ্ন দেখি। দূর থেকে হলেও কচি কচি ছেলেমেয়েদের স্বপ্নও দেখাই। সেই স্বপ্নটা যেটা প্রিন্স আমাকে প্রথম দিন দেখিয়েছিল কী এক অদ্ভুত উপায়ে। হ্যাঁ যে বুলেট নাকি শরীর ভেদ করে যেতে পারে। ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে বুক। তাকে প্রিন্স দিব্যি দু’দাঁতের মাঝে করে নাচাত। আমিও সুযোগ পেলেই সেই রাইফেলটা মজারু কায়দায় ধরিয়ে দিই কোনও এক ছেলেমানুষের হাতে। আর তারপর... তারপর তরতরিয়ে বাকি খেলাটাও উতরে দিই। আমাকে এখন সবাই পাগল ভাবে। তা ভাবুক। ম্যাজিক নামের অলৌকিক শক্তির অধিকারী যাঁরা তাঁরা তো পাগল হবেই। তাই না? সেই যে প্রিন্স বলেছিল, ‘ম্যাজিক কি আর সবাই দেখাতে পারে?’ মৃত্যুর দিন প্রিন্সের বডিটা কেউ ছোঁয়নি। ভয় পেয়েছিল যে। যে প্রিন্সকে একদিন মানুষ মাথায় করে রেখেছিল তাঁরাই তাঁকে দূর দূর করেছিল। নিজে হাতে করে কবর দিয়েছিলাম প্রিন্সের শরীরটাকে।
এখন সকাল বিকেল এখানেই এসে বসি। আমার ডায়ে বাঁয়ে আগুপিছু সার সার বোবা মানুষের শরীর। প্রিন্স আমার সঙ্গে আর কথা বলে ন। কিন্তু জানি প্রিন্স একদিন কথা বলবে। একদিন ঠিক ম্যাজিক করে বদলে দেবে গোটা দুনিয়াটা। আর তাইতো রোজ আসি। হাতের আড়ালে জ্বালিয়ে দিই একটা আলোক শিখা। মাঝে মাঝে তিরতিরিয়ে কেঁপে ওঠে সে আলোক শিখা। কখনও ‘হ্যাঁ’, কখনও ‘না’ ভাষায় আমায় কত কী বলে যায়। এখানের ঝোপঝাড়, সবুজ কালচে পাতা, ওই চড়ুই জোড়া, লুকিয়ে থাকা সরীসৃপ আমাকে চেনে। ওরাই আমার প্রতিবেশী। ওদের কাছে খবর আছে।
সে আসছে... সে আবার আসবে... আসবে তার চোখধাঁধানো সব ক্ষমতা নিয়ে। কারণ জায়গাটার নামই যে ম্যাজিক...।
(সমাপ্ত)
রুমেলা দাস।
Comments
Post a Comment