বসন্ত আসেছিল তাদেরও মনে । গল্পের নাম - "রাজা,রানী ও সিপাহী"
গল্পের নাম-"রাজা,রানী ও সিপাহী"
বাইরে চুলরঙা অন্ধকার।শীত আস্তে বেশ দেরি।চৌকাঠ পেরিয়ে ঢোকবার আগের মুহূর্ত।তাই একটু আধটু রিয়ার্সেল সেরে নিচ্ছে।উড়িয়ে দিচ্ছে উত্তরের পর্দাকে।দরজার উপরে লাল-সাদা ঘড়িটা মুখ চেপে সময় জানান দিচ্ছে।ব্যাটারি শেষের দিকে।
সারাদিনের ঝক্কি এই সবে মিটলো।গা হাত যেন পাকা ফোঁড়ার মতো ব্যথা করে তুলেছে।মনে হচ্ছে দক্ষ সাঁতারুর মতো,ঝাঁপিয়ে পড়তে টান টান করা চাদরের উপর।গোটা দিনের ইকির-মিকির মাথার মধ্যে কিলবিল করছে।নিজেকে মাঝে মধ্যে আমসত্ত্ব বা আখের গুড় বলে বোধ হয়।যে পরিমান পাড়াতুতো,মাসতুতো আরো তুতো সম্বন্ধীয় কৌতূহলের মাছি চারিদিকে ভন্ ভন্ করছে,তাতে কালা হিট-ও ফেল।ক্লান্ত শরীরটাকে টান টান করে একটা ফ্লেক ধরালো উশীনর।চোখ বুজে বালিশে মাথা রাখতেই এক অদ্ভুত আরাম বোধ হলো।
(এক)
বাড়ি পৌঁছতে ঘড়ির কাঁটা একটা ছাড়িয়েছিলো।হাওড়া স্টেশন থেকে ভবানীপুর পদ্মপুকুর রোড পৌঁছতে মিটিং,মিছিল দাবি দাওয়া না থাকলে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগার কথা।ওলা ক্যাবের জানলা দিয়ে বহু পুরোনো শহরটাকে দেখছিল ও।কেমন হাটভাঙ্গা লাগছিলো।চারপাশের রংবেরঙের হোডিং,তার সাজপোশাক হারিয়ে শুষ্ক কাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।দু-চারটে প্যান্ডেল মেকআপ হীন চরিত্রের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে।মাইক আর জোরালো আলোর তারগুলো দাঁত বের করে ঝুলে আছে লাম্প-পোস্টের গায়ে।পুজো মিটেছে সদ্য।তাই শহরের বেশভূষা আড়ম্বরহীন।এমনটাই পছন্দ ওর।তাই পাস কাটিয়ে,ভিড় এড়িয়ে বেছে নিয়েছে এই সময়টা।
আজ ছয় বছর পর কলকাতা ফিরছে উশীনর।ফিরছে ঘরে,ফিরছে মা-র কাছে।ফিরছে আরো কি কারো কাছে?জানেনা,সত্যি জানেনা।সেই বুকের কাছে হাজার হাতুড়ি পেটা দিনগুলো,সেই গলার কাছে দলা পাকানো কথাগুলো,সেই পাড়া কাঁপানো ল্যাভেন্ডার-এর গন্ধ এখনো কি তেমনি বেঁচে আছে?এখনো কি চক্রবেড়িয়া লেনের বাদামি রঙা দোতলার বারান্দা অপেক্ষা করছে?কদম ফুলের মিষ্টি গন্ধ মেখে কেউ কি ছুঁড়ে দেবে কোনো চিরকুট?চলতে চলতে নিজের অজান্তেই কি চোখ চলে যাবে অন্য কোথাও?রাপিড ফায়ারের মতো একের পর এক নন-স্টপ প্রশ্ন চলতে থাকে মাথার মধ্যে।মনটা তেতো হয়ে যায়।ভালো খারাপের এক অদ্ভুত মিক্সটার শরীর জুড়ে পাক খেতে থাকে।নোনা ধরা মন নিয়ে পৌঁছে যায় বাড়ির গেটে।ছোটমাসীদের দোতলা পেরিয়ে বন্ধ দরজার দিয়ে এগোতেই মনে হয় ওপারে একশোটা কৌতূহলী চোখ ওরই অপেক্ষায়।হাত বাড়াতেই ঠিক আগের মতোই মা দরজা খুলে দিয়েছিল।কিভাবে যে টের পেয়ে যায়।এত লুকানো,এত আড়াল একমাত্র মা-র কাছে এসেই বড় আলগা হয়ে পড়ে।সেই ছোট্ট থেকে।ছোট্ট,বেঁটেখাটো,গোলগাল চেহারার একজন মানুষ।বাংলা সিরিয়ালে চিরটাকাল বাঙালি যেমনটা দেখে এসেছে।এরপর একে একে মেজমেসো, ছোটমামা,ছোটমাসি-র আদর,চিমটি,ঠেলা খেতে খেতে পৌঁছেছিল বসার ঘরে।সারাদিন কেটেছিল হাবিজাবি কথা আর মা-র হাতের মনভরা খাবার খেয়ে।এই কবছরে সব থেকে বেশি মিস্ করেছে মা-র হাতের রান্নাকে।তাই একেবারে কব্জি ডুবিয়ে আকণ্ঠ খেয়েছিল চরম বাঙ্গালিয়ানায়।ভুলে গেছিলো দশ-বারো জোড়া চোখ তাকিয়েছিল ওরই দিকে।
(দুই)
হটাৎ বাঁ-হাতের কড়ে আঙুল ঘেঁষে বব-ডিলান মিহি সুরে গেয়ে ওঠে।এম-আই স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে সৈনিক।আপনা থেকেই ভ্রূ-দুটো পরস্পর সামনে এগিয়ে এলো।সবুজ সংকেত ডানপাশে সরিয়ে কানে দিতেই ওপাশ থেকে বাঁশচেরা গলা বলে উঠলো-"কি গুরু,চাট্ সাজিয়ে বসে আছি তো!!"
"না রে ভাই,আজ খুব ট্রেস গেছে।একটু ঘুমাবো!"-ক্লান্ত গলায় একটা হাই তুলে ফোনটা কাটলো ও।এই এক ফেবিষ্টিক,ছোট থেকে এমনভাবে আটকে আছে যে,হাজার রিমুভারেও তোলা মুশকিল।দূর সম্পর্কীয় তুতো ভাই হওয়ায় আদরে-অনাদরে বাড়িতে,কোচিনে,ঘাঁটিতে সবেতেই অনায়াস প্রবেশ।আবদার ছিল এতবছর পর আসছি।জমাটিয়া আসর চাই।'ব্লেন্ডার প্রাইড'-কে সাথ।'স্মৃতিকণা'-র স্মৃতি উথলে উঠে যখন উশী-র কেরিয়ারের তরীকে প্রায় ডুবিয়ে দিতে দিচ্ছিলো।তখনই লালচে রঙিন শিখিয়েছিল কিভাবে সাঁতরে উঠতে হয় পাড়ে।সেই থেকেই দোস্তি পানীয়ের সাথে।আর সমস্ত তাপ শরীরে ব্যাথার প্রলেপ লাগিয়ে দেয়।নেশায় বুঁদ হয়ে,ঝিম ধরা মাথায় কেটে যেতে পারে গোটা একটা দিন,গোটা একটা রাত,গোটা একটা জীবন।
জীবনে ছাব্বিশটা বছর কেটে গেছে।সঙ্গী কেবল হতাশা।বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের হাত ধরে চলে আসে কলকাতার দাদুর বাড়ি।তিনতলার অংশটা মা-র নামে লিখে দিয়ে গত হন দাদু।সেই থেকেই আত্মীয়তা এই বাড়ির সাথে,পাড়ার সাথে,ঘরের সাথে।কিন্তু কোথাও যেন এক গোমড়া মন উশী রাজাকে,সত্যিকারের রাজা হতে দেয়নি।বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন উশীনর।পুরানের কোনো অজানা দানবীর রাজা।তবে এ রাজার দানও নেই,বীরত্বের কোনো লক্ষণ আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি।মা হেসে কখনো বলে-"এ রাজার সিপাহী সৈনিক আছে বটে!"এভাবেই গ্রাফের রেখা মাথা নিচু করে এগোচ্ছিল।কখনো সামান্য উঁচু,আবার কখনো ধীরে।আচমকাই ঘটলো সেই বিস্ফোরণ!সরস্বতী পুজোর দুদিন পরে পাড়ার ফাংশনে।গিটারের সারগাম তখন আঙুলে।তাই কয়েকটা রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাল মেলাতে হয়েছিল।সেদিনের সব সুরই বেসুরো হয়ে গেছিলো সামনের সারিতে বসা মেয়েটাকে দেখে।অমন মন কেমন করা চোখ কেন ওকে দিয়েছে ভগবান? বাদামি চোখ,গোলাপি আভার ঠোঁট,বালিঘড়ির মতো ফিগার উশীনরকে ওর বোল্ড আউট করে ছেড়েছিল।সেই থেকে যে রাহুল দ্রাবিড়ের টেস্ট ম্যাচ খেলে চলেছে আজও তা টোয়েন্টি টোয়েন্টি হয়ে উঠতে পারলো না।কখনো ম্যাডেস্কোয়ারের ঘাসে, কখনো বালিগঞ্জের পিচঢালা রাস্তায়,কখনো তুমুল ভিড়ে উঁকি মেরেছে মন।ছুঁতে চেয়েছে পাতলা কোমর।হাতে হাত রেখে বলতে চেয়েছে তুমিই আমার রানী।কিন্তু কেমন এক অপরাধ বোধ কাজ করতো সবসময়।দামি বাবার দামি মেয়ে স্মৃতি।প্রথম আলাপ পরিচয় যতটা এগিয়েছিল সৈনিক,আর ওদের পাশের বাড়ির টুয়া-র দৌলতে।সৈনিক,টুয়ার বন্ধুত্ব জমাটি।পড়ার কবে কি অনুষ্ঠান হবে!!কবে কার বি-ডে সব একেবারে ঠোঁটস্থ ওদের।আরো কত কি!
(তিন)
"উশী,আই উশী ঘুমাচ্ছিস নাকি?দ্যাখ,কে এসেছে!! দরজাটা খোল! স্মৃতি এসেছে,তাড়াতাড়ি আয়!"-- মা-র কথায় কারেন্ট খেলো যেন উশী।শিরায় শিরায় জ্বলে উঠলো হাজার তুবড়ি।
কে এসেছে? স্মৃতি? আমার সাথে দেখা করতে? আজ!তাহলে কি এতদিন আমার জন্য অপেক্ষা করেছে? এতগুলো বছর! কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা।নিজেকে একটা চিমটি কেটে দেখে।নাঃ, ও তো জেগেই আছে।
"কি রে কি করছিস?তাড়াতাড়ি আয়!"--আরেকবার মা-র গলা পেল ও।
ভালোলাগা,আনন্দ সব মিলিয়ে মনে হলো আজকের রাতটা উশী-র কাছে কালীপুজোর রাত।চারদিকে মোম জ্বলছে উশী-র মন জুড়ে।
দরজা খুলে ডাইনিং-এ পা রাখলো।সামনে স্মৃতি,স্মৃতিকণা মুখার্জী--"কি রে? কেমন আছিস!শুনলাম তুই এসেছিস......আমি বাড়িতে.....পুজোয়....."আর কিছুই মাথায় ঢুকছিল না।একের পর এক কথাগুলো রেকর্ড ক্যাসেটের মতো পেঁচিয়ে যাচ্ছিলো।ওদের মাঝ দিয়ে যাচ্ছিলো শত সহস্র লোকাল।মাটি চিড়ে কোনো দানব যেন হাত বাড়াচ্ছিলো উশীর দিকে।ওর সামনে দাঁড়িয়ে এ কোন অচেনা স্মৃতি।ঘোলাটে চোখ,রঙিন সিঁথি,শক্ত করে ধরে রাখা শিশু হাত।পাশে দাঁড়িয়ে এক পুরুষ।এক জয়ী পুরুষ।ঝাপসা লাগছিলো চোখটা।সমস্ত ঘরটা ভরে গেছে ছাই রঙা মেঘে।স্মৃতি,যেন আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে কোন বিস্মৃতির আড়ালে।প্রকৃতির বড় দুর্যোগের দিন আজ।এখান থেকে উদ্ধারের পথ নেই।বাবাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে।
(চার)
মা-র পঞ্চব্যঞ্জনও আজ গলা দিয়ে নামছে না।তেতো মন নিয়ে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে ঘরে এলো উশী।জানলার বেশ খানিকটা উপরে সাদা নেতানো আলো।অদ্ভুত একটা থমথমে ভাব।ওপরের সিলিংটা যেন মুহূর্তে কচ্ছপের পিঠের মতো উল্টে পড়বে ওর বুক জুড়ে।টুকরো টুকরো ভাঙ্গানগুলো পরিণত হবে ক্ষুদ্রতিক্ষুদ্র-এ।ওর জীবনে আর কোনো আলো নেই।দিকচিহ্ন নেই।আছে শুধু ভেসে যাওয়া এক শূন্য তরী।শরীরটাকে বিছিয়ে দিলো নরম বিছানায়।তিরতির করে এক জ্বালা ঘুরে চলেছে গুরু মস্তিস্ক জুড়ে।পারছেনা আর কিছুতেই শান্ত রাখতে পারছেনা নিজেকে।বিছানা লাগোয়া বুকসেলফটায় চোখ পড়লো।এতে কি আছে কোনো সোনার কাঠির গল্প?কোনো ঘুমপাড়ানির গান?অনেকগুলো চেনা মলাটের মধ্যে চোখে পড়লো এক গাঢ় নীল মলাট।নাকে এলো নতুন মলাটের গন্ধ।হাত ছুঁলো না পড়া খরখরে সাদা পাতায় কিছু কালো অক্ষর।
'দূরে,ওই দূরে সুইমিং পুলের সামনে রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে ও।বারবার ঘড়ি দেখছে।কমলারঙা এক ওড়না উড়ে কাঁধের উপর পড়ছে।মনে হচ্ছে ও যেন হাতছানি ডাকছে।কিন্তু এত পথ পেরোবে কি করে উশী?রায়েদের কামরাঙ্গা থেকে পুলের দূরত্ব আড়াই মিনিটের।পথ যেন যোজন বিস্তৃত।পথ যেন আরো আরো বেড়ে চলেছে......কিছুতেই পৌঁছতে পারছেনা ও।উশীদা কি করছো?'--হাত ধরে কে যেন হ্যাঁচকা টান দিলো।আরে পরে যাবি তো!-চোখ খুলতেই দেখে মা।মুখের কাছে অল্প ঝুঁকে জিজ্ঞেস করছে-"ভয়ের স্বপ্ন দেখছিলি? অনেক বেলা হলো যে বাবা,তাড়াতড়ি মুখ চোখে জল দিয়ে আয়।খাবার বানিয়েছি।"-কিছুই বুঝতে পারছিলোনা ও।স্বাদহীন জলে মুখ ধুয়ে আয়নায় দেখলো নিজেকে।চাপা দাড়িতে মুখের অনেকটাই ঢেকে গেছে।হয়তো অনুভূতিও।মাথার ভিতরে এখনো দপদপ করছে।
মিহি সুর,বব ডিলান,সৈনিক---
"কি রে?উঠলি?তাড়াতাড়ি চলে আয় ঠেকে তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে!"
"না রে,বিকালে যাবো।ভালোলাগছেনা।"
"ভালোনালাগার চক্কর ছাড়।তুই আস্তে না পারলে আমি আসছি।"
"আচ্ছা দাঁড়া, দেখছি।"
"দেখছি না আসতেই হবে।"--বলে ফোনটা কেটে দিলো সৈনিক।এমন নাছোড়বান্দা পাবলিক আর দুটো নেই।কেন যে এত জেদ করছে? কাল রাতের পর আর কি সারপ্রাইজ থাকতে পারে ওর জীবনে!মোবাইল স্ক্রিনে সকাল দশটা।স্বপ্ন,বাস্তব,সৈনিক সব একসাথে পেরেক ঠুকতে শুরু করেছে মাথার মধ্যে।
(পাঁচ)
দুটো ব্রেড মুখে পুরে ও বেরোলো।ভালোলাগছেনা।কিচ্ছু ভালোলাগছেনা।কাল রাতে বইটা পড়তে পড়তে কখন যে চোখ বুজে এসেছে বুঝতেই পারেনি।অনেকদিন পর বাংলা কিছু পড়লো।খুব সুন্দর সহজ লেখনী।গল্পকারের নাম না দেখলেও গল্পের বাঁধন আর বুনন অদ্ভুত!উশীর ঘুম কি এলো মন জুড়ানো লেখনীতে!আর স্বপ্নটা?
আবার ফোন।রিসিভ করেনি উশীনর।চলতে না চাওয়া পা দুটোকে টেনে নিয়ে চলতে থাকে।আলসে রংওঠা একটা সকাল।মনখারাপ দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশ জুড়ে।ক্লাব পেরিয়ে কৃষ্ণচূড়ার তলাতেই ওদের ঠেক।সকালে সচরাচর ফাঁকা থাকে এদিকটায়।সৈনিকটা কি করতে যে?....ওই যে দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে!!
"কি রে? কি হয়েছে তাড়াতাড়ি বল!"--উশীর মুখে মনখারাপ আর বিরক্তির মিশেল।সৈনিক ভ্রূ নাচিয়ে আঙুল তুলে ওকে সামনের দিকে কি একটা দেখালো।আঙুল বরাবর তাকাতে দেখলো কমলা ওড়নার একরাশ ঘন চুলের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে।সামনে ক্রস করা একটা ব্যাগ।খুব চেনা চেনা লাগছে।আরে এত আমাদের টুয়া?কত বড় হয়ে গেছে!!ও এখানে হটাৎ!!
"টুয়া তুই এখানে?বাড়িতে যেতে পারতিস তো!এইভাবে?হটাৎ!!"-উশীর কাছে এ যেন এক মস্ত ভুলভুলাইয়া।সমাধান খুঁজতে সৈনিকের দিকে তাকাতেই......
"কি জানি,ও কি সব দরকারি কথা বলবে তোকে!ওরা এখান থেকে চলে গেছে অনেক দিন হলো।তোর সাথে দেখা করে যাচ্ছে,এদিকে কি একটা কাজ আছে তাই।আমি কাটি বস্ বিকালের আসর সাজাই।"--সৈনিক কাকে যেন ফোনে গালাতে গালাতে এগিয়ে গেল পাঁচিল বরাবর।ও যে ব্যাপারটায় পাস কাটলো সেটা বুঝলো উশী।কিন্তু এসবের মানেটা কি?ছোট থেকেই মা-র কোল ঘেঁষত সৈনিক আর টুয়া।তবে আজ নয় কেন?আজ কি এমন বিশেষ দিন!কি ঘটতে চলেছে?
মাঝে আকাশের স্বমহিমায় এগোচ্ছে।পাঁচিলে বসা মাছরাঙ্গাটা রঙ্গিনে মুখ ডুবিয়েছে।আলতো হেসে সলজ্জ ধীর পায়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে টুয়া।
"কেমন আছো উশীদা? কি হাল করেছো নিজের? ইস,মুখ তো নয় পুরো ছোটখাটো জঙ্গল।সন্ত্রাসের চেহারা করেছো।
আমরা পাড়া ছেড়েছি তিন বছর হলো।সোদপুরে বাবা ফ্ল্যাট কিনেছে।সৈনিকদার কাছ থেকে আমি তোমার খবর পেতাম মাঝে মধ্যে।"-কথাগুলো একনাগাড়ে বলে থামলো টুয়া।
"তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে উশীদা।"-সত্যিই তাই।তবে এ ক্লান্তির ভাষা অন্য।অনেক হাঁটার পর হটাৎ পাওয়া কোনো ছাওয়ার মতো।আজ আবার যেন এক অপরাধবোধ কাজ করছে।মনে পড়ছে কিছু আবছা।সতেরো বছরের প্রেমে হাবুডুবু কোনো কিশোর,তার সুর বাঁধছে কখনো কলমে,কখনো গিটারে।আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট করে কাটা চুল,হরলিক্সের কাঁচের মতো মোটা ফ্রেম, গোলগোল চোখের এক ছেলেসুলভ মেয়ে।হয়তো তার সুরে রঙিন হবে বলে।
"উশীদা,তোমার অফিসটা শুনলাম অনেক বড়।আর জায়গাটাও নাকি খুব সুন্দর!তোমারও বেশ নামডাক আছে শুনেছি।কন্টেন্ট রাইটার বলে কথা!!---এ যেন অন্য কোনো টুয়া।এ যেন এক অন্য ভালোলাগা।এ ভালোলাগা একান্তই নিজের।
স্তব্ধ হয়ে থাকা ছাড়া উপায় কি!
"তুই কেমন আছিস?কাকু,কাকিমা?বাড়িতে আস্তে পারতিস তো!"--জড়িয়ে আসা জিভটাকে কোনোমতে সামলে কথাগুলো বললো উশী।
"হ্যাঁ, পারতাম তো।আসলে বাবার একটা দরকারি কাজের জন্য খুব তাড়া আছে।আর তোমার বাড়ি গেলে কাকিমা কি আমাকে অতো সহজে ছাড়বে!"--পুলের জল সামান্য কাঁপছে।আলতো হাওয়া দাগ কেটে যাচ্ছে পুলের মাঝখানে।যেখানে ফোয়ারার স্ট্যান্ড দুটো বক পাশাপাশি।একে ওপরে মগ্ন।
"উশীদা আমি আজ আসি।কখনো সময় হলে আমাদের বাড়ি এসো।"---নম্র সোহাগ মিশে রয়েছে টুয়ার প্রতিটা কোথায়।
"আর এই নাও।এটা পড়ো পারলে।তোমার জন্য।"---চারকোনা রঙিন মলাটের একটা উপহার দিয়ে টুয়া এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
এ কোন টুয়াকে দেখছে ও।কিছুতেই মেলাতে পারছেনা বছর খানেক আগের দিনগুলোর সাথে।এ যেন বড্ড নতুন,বড্ড আনকোরা।অথচ এসব বড়ই চেনা হওয়া উচিত ছিল।এই চেনাকেই বড় বেশি প্রয়োজন ছিল ওর বিজ্ঞাপনহীন জীবনে।ইচ্ছে করছিল ওকে যেতে না দিতে।কিন্তু কি বলে ওকে আটকাবে উশী? ওর যে কিচ্ছু বলার নেই।সৈনিক,ও তো অন্তত পাশে থাকতে পারতো এই সময়টায়।বুকের সমস্ত বুদ্বুদ গুলো ফেনা হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে চারপাশটায়।উশী শুধু চোখ মেলে তাকিয়ে টুয়ার মিলিয়ে যাওয়ার দিকে।দেখছে ওর ফিরে এসেও চলে যাওয়াকে।
একরাশ প্রশ্ন আর তালপাকানো মাথা নিয়ে ঘরে এলো উশী।হাতে লাল মলাট? কি আছে ওতে? কি অপেক্ষা করে আছে ওর জন্য! রঙিন খুলতেই নাকে এলো সেই নতুনের আনকোরা গন্ধ।হাত ছুঁলো কিছু না পড়া কালো ছাপার অক্ষর----
"আজ আকাশটা অন্যরকম।সময় পেরিয়েছে অনেকটা।তবু বদলায়নি কিছু।তোমাকে হারিয়ে নিজেকে গড়েছি নতুন করে।তোমার মত করে।জানিনা তোমাকে পাবো কিনা,অপেক্ষা তোমার।তোমার ভালোবাসার।"
টুয়া(ছদ্মনামে শ্রেয়সী)
পরম আদরে লাল মলাটে হাত রাখলো উশীনর।কাল রাতে যে সোনার কাঠির স্পর্শে ওর চোখে ঘুম এসেছিল তা ছিল টুয়া-রই কলমের জাদুকাঠি।ও আজ এক নামী লেখিকা।বহু কিশোর,যুবকের হার্টথ্রব।সমাজের কাছে ও শ্রেয়সী।কিন্তু উশী -র প্রেয়সী।এ কোন মায়াপুরিতে এসে পৌঁছেছে উশী।এ কোন পিক্সসিডাস্ট ওর শরীর জুড়ে।ভালোলাগাগুলো একের পর এক খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে।ভালোবাসা পাশে থাকে।অপেক্ষা করে।হাতে হাত রেখে বলে পাশে আছি,থাকবো।
চোখের কোনাটা চিক চিক করে ওঠে উশী-র।
|
Comments
Post a Comment