"ঋভুর রুটিন"
ধপাস করে দরজার সামনে পড়লো একটা মুখ হাঁ করা বাসা। পিছন
থেকে জেঠিমার চিল চিৎকার কানে তালা লাগিয়ে দিল,
"ও ছোটো, ডিম পড়েছে ডিম পড়েছে।
বারান্দার উপরের তাকে বজ্জাত পায়রাগুলো বাসা বানিয়েছিল। ওদের
যেন দেখতে দিস না। সর্বনাশ হয়ে যাবে!"
আর সাথে সাথে পাশ থেকে রিমিদিদি চোখ বুজে দিল চোঁচা
দৌড়। আরেকটু হলে হুমড়ি খেতো আরকি! পায়ের দিকে তাকাতেই ঋভু দেখল প্লাস্টিক, গাছের শুকনো পাতা, খড়, কোথাকার
কোন ইলেক্ট্রিকের তার রাজ্যের এলোমেলো জিনিস দিয়ে তৈরি একটা বাসা।
তাতে হলদেটে সাদা গোল পুঁচকে পুঁচকে দুখানা ডিম।
"ওমা!" বলে
ঋভু বাঁ-কাঁধের ব্যাগটাকে হড়কে নীচে ফেলে যেই না ধরতে যাবে, অমনি
"ধরিস না, ধরিস না, দেখিস না, ছুঁস
না..." গোটা পাঁচ-আট 'না' বিভিন্ন সুরে বিভিন্ন তালে ছুঁড়ে তেড়ে এল ওর মা।
তা সে, যে অস্ত্র যে বেগেই আসুক না কেন। ততক্ষণে
বাসা ঋভুর হাতে।
"এ ছেলেটাকে নিয়ে আমি আর পারি না। বিপদ না করে ছাড়বে না দেখছি!"
ঋভুর মা, জেঠিমা দুজনেই তুমুল বিলাপ করতে শুরু করে
দিয়েছেন। ওর মন কিন্তু আনন্দে পিলপিল করছে। একলাফে বারান্দা টপকে সোজা সটান তরতর করে উঠে গেছে
সিঁড়ি বেয়ে। উপায় নেই। মাথায় প্ল্যানটাও খেলে গেছে। এটাকে চোখের সামনে রাখলে যতক্ষণ
ও পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরবে ততক্ষণ নিশ্চই আর বাসারও হদিশ পাবে না।
মা ঠিক ফেলে দেবে। কুন্ডুকাকু আরও বার-চারেক হর্নটা বাজাল। স্কুলের
ভ্যান এসে গেছে যে। ঝটপট আরও
তাড়াতাড়ি করতে হবে কাজটা। পুরোনো
খেলনা ভাঙা যে পিচবোর্ড-এর
বাক্সটা পিলুর মা ছাদে, টবের
পাশে রেখেছে সেটাকে বগলদাবা করে, তাতেই গুঁজে দিল বাসাটা। এদিক ওদিক থেকে ডানা ঝাপটানো ফরফর আওয়াজটা বাসা পড়ার
সাথে সাথে হচ্ছিল। এখন ও দেখল, আওয়াজটা থেমে ছাদের
কার্নিশে এসে বসেছে। দুটো
পায়রা। এই কদিন বকম বকম, ফরত ফরত, ফটর
ফটর, আর গাদা গাদা সাদা,খয়েরি পটি করে সারা বাড়ি মাতিয়ে
রাখার কর্ম এরাই করে তাহলে? আর
গজ গজ করতে করতে পরিষ্কার করে যে যখন পারে! পায়রাদুটো
গলাটাকে একবার ছোটো আর একবার বড় করছে। পুঁতির মতো লাল লাল গোল চোখ দিয়ে দেখছে ঋভুকে। ঋভুর আর দেখার সময় নেই। সরাৎ করে বাক্সটাকে টেনে আলতো করে ঢুকিয়ে রাখে ট্যাংকের
তলার ফাঁকা জায়গাটায়। নিচের হল্লা আরও আরও
বাড়ছে। কোনোমতে
হাত ঝেড়ে খানিকটা প্যান্টে মুছে,
একনিমেষে বোল্ট দৌড় দিল ঋভু। সোজা
বাড়ির গেট। রেহাই কি আছে?
আঁকশির মত আঙ্গুল ততক্ষণে পাকড়েছে ঋভুর নোটা ডান কান।
"আঃ লাগছে মা!"
"এবারও তোর কপালে গোল্লা আছে।"
পড়ে থাকা ব্যাগটা হিঁচড়ে ভ্যানে রেখে মায়ের গালে চুমু
খেল ও। ভ্যানে বসে দেখল,
রিমিদিদি তখনও চোখ বুজে কি যেন বিড়বিড় করে বলছে। একবার হাত কপালে ঠেকাচ্ছে আরেকবার বুকে।
'জয় মা সরস্বতী!'
ঋভুও ভ্যানের জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল।
মা, জেঠিমা ব্যাজার মুখে।
আর পাখিদুটো?
উড়ে উড়ে ঘুরছে দোতলার বারান্দায়।
**************
বারান্দাতে-ই
চেয়ার পেতে বসেছেন ঋভুর বাবা। এ হল পরীক্ষা নম্বর ২। মানে
শ্রেণীঘরে লেখা বা বলা উত্তরগুলো মিলিয়ে দ্যাখেন সজল সমাদ্দার, অফিস থেকে ফিরে তবে তার শান্তি।
একেক করে বলে চলেছে ঋভু।
প্রশ্ন- সোজা? উত্তর- সাপ্টা
প্রশ্ন- গাঢ়? উত্তর- খয়েরি
প্রশ্ন- সাদা? উত্তর- পায়রা
"কি বলছো কি ঋভু তুমি? এগুলো বিপরীত শব্দ হচ্ছে? কে শিখিয়েছে তোমায় এসব? পইপই
করে সব মুখস্থ করিয়েছিলাম।"
চেয়ার ছেড়ে উঠে
দাঁড়িয়ে কটমট করে তাকালেন ছেলের দিকে। ঋভুর
মনে হল, বাবা এক্ষুণি ওকে জল দিয়ে গিলে ফেলবে।
"আমি জানতাম এরকমই একটা কিছু
করবে ও। সকাল
সকাল যা কাণ্ডটা বাধিয়ে স্কুলে গেছিল। শুভ কাজে গেলে ডিম দেখতে নেই পর্যন্ত।
আর ও কিনা ছুঁয়েটুয়ে একাকার। আর
পায়রাগুলোও বলিহারি। ডিম ফেলবি তো ফ্যাল পুরো ছেলেমেয়েগুলোর
যাবার রাস্তায়। কি অলুক্ষণে।"
ঋভু বুঝল বাবা-মা দুজনেই ক্ষেপে গেছে।
তবে এটা বুঝল না ওর ভুলটা কি? বাসাটা
পড়ে গেছে। যাতে ডিমগুলো না নষ্ট হয়, ও
সরিয়ে রেখেছে। ব্যাস। তার সাথে পরীক্ষা খারাপ হবার কি
আছে? পরীক্ষা দেবার সময় মনটা খুঁতখুঁত
করছিল, কেউ যেন বাক্সটা দেখতে না পায়।
বাড়ি ফিরে তাই একটা কাপড় দিয়ে আড়ালও করে দিয়েছে। অংশুকে স্কুলে গিয়েই বলেছে।
ওর দাদু পায়রা পুষতো আগে শুনেছিল। ওদের ছাদে নাকি ভর্তি থাকে ৩০টা পায়রা। অনেক রকমের। পায়রাগুলো ওদের বাড়ির সবাইকে চেনে। আরও বলেছিল,
পায়রারা নাকি অঙ্ক কষতে পারে। সব
থেকে বড়, বুড়ো পায়রাটা। সে
খুব বিজ্ঞ। অংশু অঙ্ক করতে না পারলেই ওই পায়রাটার
কাছে যায়।
ঋভু অংশুর কথা ক্যাবলার মত শুনছিল আর ভাবছিল তাহলে তো বেশ হয়।
অঙ্ক পরীক্ষা এখনো বেশ কিছুটা সময় আছে। ততদিনে নিশ্চয়ই পায়রাদুটো বন্ধু হয়ে যাবে।
তারপর নাহয় জিজ্ঞেস করা যাবে, অনুশীলনের যে অঙ্কগুলো কঠিন লাগবে।
"এত বাজে পরীক্ষা দিয়ে এসে দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে হাসছ? বড়দি আবারও ডাকবে আমাকে।"
এই রে! ওকে কি খুব হাসি হাসি দেখতে লাগছে? আসলে
কিছু ভাবনা এলেই, আপনা থেকে ওর ঠোঁট দুটো কান পর্যন্ত ঠেকে যায়।
ঋভু নিজের গালে হাত বোলাল। আবার
ঠোঁটদুটো ঠিক জায়গায় নিয়ে এল।
"আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না।
দু-দিন ছুটি।
ইতিহাস পরীক্ষা সামনে। মন দিয়ে সকাল বিকেল পড়া। সারাদিন টোটো কোম্পানি বন্ধ। আমি অফিস থেকে ফিরে রোজ তোমার রিভিশন নেব।"
"জানো বাবা, গৌড়কাকু আরও
দুটো নতুন টোটো কিনেছে।"
"স্বপ্না। তোমার
ছেলেকে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যাও।"
বাবা তো আরও
রেগে গেল। সত্যিই তো। স্কুল
থেকে যখন ফিরছিল তখনই দেখেছে গৌড় কাকু দু-দুটো
ঝকঝকে নতুন টোটো দাঁড় করিয়ে গোল গোল করে ধূপ দেখাচ্ছে। তাহলে কি বাবা, গৌড়কাকু টোটো কিনেছে বলে রাগ করেছে?
কে জানে?
"আবার ঠোঁট ওল্টানো হচ্ছে। দিন দিন তোমার বেয়াদপি বাড়ছে ঋভু। বাবার মুখের উপর তর্ক?" ওকে মা হাত ধরে নিয়ে এল খাবার ঘরে।
"আমি জলখাবার দিচ্ছি। একটু রেস্ট নিয়েই পড়তে বসবে। আর কোনো বাজে কথা নয়।"
আঙুল
তুলে শাসিয়ে মা রান্নাঘরে যেতেই সুবর্ণ সুযোগ হাতে পেল ঋভু।
একেবারে ছাদ।
সন্ধ্যে হয়েছে।
জেঠিমা শাঁখে ফুঁ দিয়েছে। ওদের
ছাদে লাইট আছে তাই দেখতে পাবে ঠিকই। পা
টিপে টিপে গুটি গুটি এগোল ট্যাংকের নিচের দিকে। ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছে না।
বিকেলে দেওয়া কাপড়টা সরাল।
ঝটপট ডানার আওয়াজ।
পায়রাদুটো কি ভয় পাচ্ছে ওকে দেখে?
তুক তুক তুক আঃ আঃ আঃ মুখ দিয়ে সরু শব্দ করে আরও খানিকটা
এগোল। এইবার একটু স্পষ্ট। একটা পায়রা গোল হয়ে গা ফুলিয়ে বসে। আরেকটা
ঝটফট করছে।
ডিমদুটো?
কোথায় গেল ওদুটো? এই
পায়রাটা গা ফুলিয়ে কী করছে? অংশু বলেছিল ওরা 'তা'
দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। তবে কি ও 'তা' দিচ্ছে? বাচ্চা
ফুটবে? কী মজা। কী মজা। ঋভু তালি দিয়ে ঘুরপাক খেয়ে আনন্দে নেচে নিল কিছুক্ষণ। নীচু
হয়ে বসল। দেখল পায়রাটা গা ফুলিয়ে, ঘাড় বেঁকিয়ে
ওকে দেখছে।
**************
দেখছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হাতে নিয়ে।
ডিমদুটো। কিচ্ছুটি
বলে না বড় পায়রাদুটো। মানে ওদের বাবা-মা।।তাই হবে হয়তো। ঋভু ঠিক জানে না। এদের
তো আর দাঁড়ি গোঁফ নেই যে বুঝবে কোনটা বাবা। খোঁপাও নেই, মা চুলও বাঁধে না। ও ভালো করে খুঁটিয়ে দেখেছে একটা একটু ছোটো আরেকটা সামান্য
বড়। বড় যে পাখিটা তার গায়ের রংটা খুব
গাঢ় শ্লেট আর কালচে মতন। মাথার
চাঁদি ও ঘাড়ের পেছন ধূসর সাদা। পালকগুলো আঁশের মত সাজানো একগুচ্ছ। ছোট পাখিটার গায়ে সাদাটে ভাগই বেশি। অংশু বলেছে, ছোটোটা মেয়ে পাখি মানে মা।
আর বড়টা বাবা পাখি। মাঝে
মাঝে ওরা দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ থাকে না। তখন
ঋভু ডিম দ্যাখে। একদিন মা পাখিটা চলে এসেছিল।
ঋভু ভেবেছিল এই হয়তো দিল ঠুকরে। কিন্তু মা পাখিটা গলায় ঢেউ তুলে তুলে একবার ডানদিক, একবার বাঁ-দিকে দেখে ওর গায়ের কাছে উড়ে এসে বসেছিল।
হয়তো ওর খিদে পেয়েছে। এই ভেবে, ঋভু একটা মেরি বিস্কুটের
টুকরো ওর জন্য নিয়ে এসেছিল। ও খায়নি।
ঠক ঠক ঠক করে কয়েকটা ঠোক্কর মেরেছিল মেঝেতে। তারপর আবার উড়ে গেছিল। বিস্কুট
কেন খেল না? ও কি মিষ্টি খেতে ভালোবাসে না?
পরেরদিন রেখেছিল মুড়ি ছড়িয়ে। এই দিন বেশ আনন্দ করে ঠুকরে ঠুকরে ছাদময় ঘুরে ঘুরে
খেয়েছিল। তারপর থেকে মুড়িই খায়। ঠাকুরঘর থেকে খুঁজে পেতে একটা মাটির
সরা এনে রেখেছিল বাসার মধ্যে। জল
দিয়েছিল তাতে। ওদের তো জল তেষ্টাও পায়। ঠোঁটে করে খানিকটা জল নিয়ে, মুখ সামান্য উঁচু করে ঠিক জেঠু যেমন করে গার্গল
করে অমন করেই মা, বাবা পাখিগুলো জল খায়। এসব
দেখতে হয় লুকিয়ে। একবার যদি বাড়ির কারুর নজরে পড়ে তবে আর রক্ষে নেই। আরেকটা অদ্ভুত জিনিস ঋভু দেখেছে।
প্রথম যেদিন ডিমদুটো দেখেছিল সেদিনের তুলনায় এখন একটু বড় হয়েছে ও দুটো। ইতিহাস,
ভূগোল, বিজ্ঞান পরীক্ষাও হয়ে গেছে। ইংরেজি,
অঙ্ক বাকি। অংশু
বলেছে, ১৮দিন পর বাচ্চা ফুটবে। গুনে গুনে দেখেছে, ১০দিন হয়ে গেছে। উফ
কবে যে ওই দিনটা আসবে। ওর তর সইছে না। ডিমগুলোর
একটার উপর থেকে কেমন নীল নীল শিরা দেখা যাচ্ছে। ও
ডিমগুলোর তলায় ওর গেঞ্জি ছেঁড়া পেতে দিয়েছে। ডিম যাতে ভালো থাকে। সারাদিন ওগুলোই এখন ঋভুর ধ্যান জ্ঞান, ওদের বিছানা ঠিকঠাক না করে, ডিমগুলো কেমন দেখতে হচ্ছে
তা না দেখে ওর শান্তি নেই।
ওদিকে মা সারাক্ষণ বকে। ডিম
দেখার পর থেকে মা ভাবে, ঋভু খুব বড় বড় গোল্লা পাবে খাতায়। ঋভুর
যে সারাক্ষণ জেঠতুতো দিদির মত বই নিয়ে বসতে ভালোলাগে না।
রিমিদিদি ওর থেকে দু-বছরের
বড়। ক্লাস এইটে পড়ে। ও সিক্সে। ওর পরীক্ষা রিমিদিদির মত ওতো ভালো হয় না। রিমিদিদি প্রতিবার ক্লাসে ১০-এর মধ্যে থাকে।
কী ভাল। ঋভু ওতো ভালো না হলেও, সেদিন
সহেলি বলে একটা নতুন মেয়ে ভর্তি হয়েছে ক্লাসে। ওকে বই না দেখে বিজ্ঞানের সব পড়াগুলো বলেছে। তার
বেলা? দইয়ের ফোঁটা নিতে ভালোলাগে না। কপালে
চ্যাটচ্যাট করে। মা, জেঠিমা বলে ওগুলো শুভ। ঋভু বোঝে না। যেটা
পড়বে, সেটা মনে থাকলেই
তো পরীক্ষা ভালো হবে। তবেই তো লিখতে পারবে। রিমিদিদি
সারাবছর পড়ে বলেই কী ভালো নম্বর পায়। তবে
দই ফোঁটা ভাল কেন? আর ডিম বাজে। ওর যেন পরীক্ষার দিনগুলোতে আরও বেশি
করে ডিম খেতে ইচ্ছে করে। ধুর ছাই। পরশু অঙ্ক পরীক্ষা। একটু ভয় ভয় লাগছে। কৌশিক
স্যার কী প্রশ্ন দেবে? কে জানে। ক'টা আম কে খেল? ভগ্নাংশ,
সরলীকরণ, মৌলিক সংখ্যা, কোনটা
কার দ্বারা বিভাজ্য সব তালগোল পাকিয়ে যায়। তবে একটা খুব পছন্দের। গ্রাফ। এক্কেবারে ঝট করে সমাধান হয়ে যায়। সময় বাড়ার সাথে সাথে ধান উৎপাদন কতটা বেড়েছিল, আগের পরীক্ষায়
এই গ্রাফটাতেই ১০/১০ পেয়েছিল। প্রশ্নপত্র
পেলে আগেই করে নেয় ওটাই। বাকিগুলো পরে।
সবুজ চৌকো খোপে গুণে গুণে পুটকি দিয়ে তারপর মেপে মেপে জুড়ে দাও। বড়
একটা লাল রাইট পাবেই পাবে!
************
পাচ্ছে না কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না ঋভু। বোর্ডের
তলা, নিজের পায়ের কাছে, রণিতের
ব্যাগ পর্যন্ত উঠিয়ে দেখেছে। কিন্তু
না। কোত্থাও
নেই। অভ্যাস করে এসেছিল যেটা, সেটাই পেয়েছে পরীক্ষায়। তাই ঝটফট করে সেরে নিয়েছিল স্যার গ্রাফের কাগজটা দিতেই।
"আর দশ মিনিট!"
স্যার তাড়া দিলেন। হাত পায়ের তলা ঘেমে উঠল ওর।
গলা শুকিয়ে কাঠ। কী করবে এবার ও? বোতল চাপা দিয়েই তো রেখেছিল। কোথায়
গেল তবে? হাওয়ায় উড়ে যায়নি তো?
কিছুক্ষণ আগে থেকেই একটা উটকো হাওয়া দিচ্ছে। চারদিক কালো করে, ঢেকে গেছে নীল, সাদা মেঘ। কী করে জমা দেবে অঙ্ক খাতা?
"ঋভু রায়, রোল নম্বর ২৩।
কী করছো ওখানে? বেঞ্চে এসে বসো।"
জানলার কাছে যেতেই গম্ভীর গলায় ডাকল স্যার।
"আমার গ্রাফটা উড়ে গেছে স্যার।"
"সেকি? আর
৫মিনিট বাকি। তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও খাতা সকলে।"
স্যার কিছু বললোই না। কান্না
পেল ওর।
গ্রাফটা খুব ভালো হয়েছিল। ঠান্ডা ভেজা হাওয়াটা বোর্ডে আটকে
রাখা খাতার পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দিচ্ছে। ও ভয় পেয়ে এগিয়ে গেল বেঞ্চের দিকে।
বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস করে ড্রাম পিটতে লাগল। পাশে
বসে রণিত ততক্ষণে খাতার পাতার সাথে গ্রাফ জুড়ে দিয়েছে। পিন
দিয়ে। তাহলে
কি মায়ের কথাই ঠিক? জেঠিমাও ঠিকই
বলে? প্রথম দিন ডিম দেখেছে বলেই কি আজ এই বিপদ? ডিম
দেখল বলেই কি আজ শেষ দিন এভাবে খারাপ হল? অঙ্কে গোল্লা পেলে বাবা আর ট্যুরে নিয়ে যাবে
না পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে। সারাবছর ওই বেড়াতে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে ঋভু। অঙ্কে কি শূন্যই পাবে ও? কেন
ও ডিমগুলো দেখল? রিমিদিদি দ্যাখেনি। ওর পরীক্ষা নিশ্চই ভালো হবে। কোথায় গেলে পাবে ওর গ্রাফ?
ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রি ইইইইইয়িং - করে বেলের শব্দটা
একনাগাড়ে কানের কাছে বেজে উঠল। আর
ঠিক তখনই ঋভু শুনল খুব চেনা সেই শব্দটা ফট ফট ফট ফটর ফটর, ও চমকে জানলার দিকে তাকাতেই দেখল সাদা, শ্লেট মেশানো
একটা পায়রা বসে। মুখে
করে কী একটা নিয়ে টপাঙ করে ঠোঁট থেকে ফেলে দিলো ক্লাসের ভিতরে।
আর একটুও বসল না। উড়ে
গেল। এদিকে
সবাই খাতা জমা দেবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। কাগজটা দুলতে দুলতে যেই না মেঝেতে পড়েছে, ঋভুর আনন্দে দম আটকে আসে আর কি। আরে, এটা তো ওর সেই গ্রাফটা?
এটা কোথা থেকে পেল পায়রাটা।
হুররে...
রেররের বলে সবাইকে ঠেলেঠুলে ছোঁ মেরে তুলে
নিল কাগজটা। ইশ কাগজটার গায়ে ধুলো লেগে গেছে। রুমাল
দিয়ে কোনোমতে মুছে কাঁপা কাঁপা হাতে পিন লাগিয়ে
জমা দিল খাতা। মাথার
মধ্যে কেমন করছে ওর। এটা কিকরে সম্ভব? ততক্ষণে রণিত, সৌরদীপ, কৃষ্ণেন্দু
'কি হল', 'কি
হল' করে ভিড় জমিয়েছে চারপাশে।
ও আবারো জানলার কাছে গেল। কই নাতো! আশেপাশে কোনো পাখি দেখতে পেল না।
দূরের কোনো বাড়ির তারে একটা কাক বসে হেঁড়ে গলায় ডেকে চলেছে।
ওই পায়রাটা কি মা পায়রা? গায়ের রংটা তো অমনি সাদা ছিল? কিন্তু তা কি হয়? ও
তো ঋভুর ক্লাস চেনে না? আর তাছাড়া ওর গ্রাফটাই যে হারিয়ে গেছে সেটাই
বা জানবে কী করে? আজব ব্যাপার! জিকে
বইতে পড়েছিল পায়রা ঘরে ফেরার জন্য ব্যবহার করে "ম্যাপ সেন্স" ও "কম্পাস
সেন্স"। ম্যাপ
সেন্সের ক্ষেত্রে তারা যেখানে বাস করে সেখানকার ভূমির দাগ ও গন্ধ কাজে লাগায়। কম্পাস সেন্সের ক্ষেত্রে সূর্যের অবস্থান ও গতিবিধির
উপর নির্ভর করে। বইয়ের কথাগুলো কি সত্যি হল? বন্ধুদের
কী বলবে কিছুই বুঝতে পারল না।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল জানলার বাইরে।
টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা এসে লাগল। ওর গায়ে! সবাই আস্তে আস্তে বেরিয়ে যাচ্ছে ক্লাস থেকে। ব্যাগ
গুছিয়ে ক্লাসের বাইরে পা দিতেই দেখল, রিমিদিদি পাশের ক্লাস থেকে বেরিয়ে স্কুলের বারান্দায়
নীল দলের আঁকা সরস্বতী ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে কি সব বিড়বিড় করে বলছে, আর চোখ বুজিয়ে আছে।
আজ ওরও শেষ দিন পরীক্ষার। ঋভু
দিদির কাছে এসে দাঁড়াল। মুখ
তুলে দেখল, আঁকা ঠাকুরের মুখটা কী
সুন্দর হাসি হাসি।
*************
হাসছিল আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল ঋভু। লাল চামড়ার উপর হলদে হলদে লোমগুলো নেতিয়ে গায়ে লেপ্টে
রয়েছে। আর ঠোঁটদুটো শুধু ফাঁক করছে। মনের
মধ্যে খুব আনন্দ হচ্ছে। ডিম
দুটো ফুটে আজ বাচ্চা হয়েছে। এদিকে রেজাল্টও বেরিয়েছে। ঋভু
পাশ করে গেছে। রিমিদিদির ভালো নম্বর এসেছে কিন্তু ১০-র মধ্যে নেই। কেন কে জানে? ও
সবাইকে বলছে, ডিম দেখার জন্যই গোটা পরীক্ষাটা
খারাপ হয়েছে। কিন্তু ঋভু নিজের চোখে দেখেছে দিদি চোখ বুজিয়ে ছিল। বাড়ির
সবাই দিদির কথা বিশ্বাসও করছে। আর
ও? ঋভু বিশ্বাস করছে না, কাউকে বিশ্বাস করাতেও পারছে না যে পায়রাটা গ্রাফের পাতা
না দিলে, ও হয়তো পাশ-ই করতে পারত না।
সবাই ভাবছে গল্প কথা। তাই ও এই পায়রার ডিমগুলোর কথা, ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার কথাও কাউকে বলেনি।
স্কুল থেকে ফিরেই জানাতে এসেছিল মা আর বাবা পায়রাকে। সেদিনের পর থেকে মা পায়রাটাকে কতবার দেখেছে আর ভেবেছে
তাহলে কি ওই ছিল সেদিন? আজ আর ওসব ভাবতে চায় না। হাতে করে মুড়ি এনেছিল। তু
তু তু করে দিতেই ওরা আজ আর নিজেরা খায়নি। মুখে
করে নিয়ে বাচ্চাগুলোর কাছে নিয়ে যাচ্ছিল।
"ঋভু অ্যাই ঋভু কোথায় গেলি? নীচে
আয় ড্রয়িং পরীক্ষা আছে তো!" মা ডাকছে। তাইতো আজ শনিবার। আঁকার স্কুলে পরীক্ষা। ভুলিয়ে গেছিল ও। মা
নিশ্চই খেতে ডাকছে। আসলে
স্কুল ড্রেস ছেড়েই চলে এসেছিল।
"যাই ইইইইই" বলে আস্তে করে ডিমের খোসাদুটো ময়লার জায়গায় ফেলে দৌড়
লাগাল নীচে। খাবার টেবিলের সামনে এসে চক্ষু চড়কগাছ, মা যে ডিম ভেজে দিয়েছে।
মাথা চুলকে মায়ের দিকে তাকাতেই দুহাতে জড়িয়ে ধরে স্বপ্না
দেবী। ও মনে মনে হাসে, ভাবে আজ থেকে ঋভুর
রুটিনে আর কিচ্ছুটি থাকল না। শুভ
কি অশুভ। আরও
আরও মন দিয়ে পড়বে শুধু। আর অনেক অনেক থ্যাংকস জানাল পায়রাটাকে।
মা সরস্বতীকে।
(সমাপ্ত)
(প্রকাশিত ক্রমশঃ কিশলয় ওয়েব পত্রিকা, ২০১৭)
Comments
Post a Comment