টুনু




এই নিয়ে তিন-তিনবার ঘটেছে ঘটনাটা প্রথম প্রথম হালকাভাবেই নিয়েছিল অবিনাশ কিন্তু যতটা সহজ বলে মনে করেছিল ব্যাপারটা ততটাও সহজ বলে মনে হচ্ছে না একটা নয় পরপর তিনটে ইংরেজি লেটার কিভাবে লেখা হল? ল্যাপিতে লেখার অভ্যাসটা বেশ কয়েকবছর হল রপ্ত করেছে ওটুকটাক কাজের জন্য লেখা ছেড়ে উঠে গেলেও শেষ কি লিখেছে সেটা অন্ততঃ মাথায় থাকে অথচ বাংলা শব্দের পর ইংরেজি শব্দ? কিকরে? একবার মনে হয়েছিল লাস্ট একমাস ধরে ইংলিশ অনলাইন ক্লাশগুলো যেভাবে ফলো করছে তারই এফেক্ট নয়ত? আসলে অবিনাশ বাংলাতে বেশ জোরালো হলেও ইংরেজিতে যাকে বলে তথৈবচকিন্তু বাংলা সাহিত্য লিখতে গিয়ে বুঝেছে শুধু ওই একটাকেই আঁকড়ে নিয়ে থাকলে হবে নাযেকোনো সাহিত্য নিয়ে চর্চা করতে গেলে অন্যভাষার সাহিত্যও সমান জানতে হবে সেটাই কি কোনওভাবে মনের অবচেতনে রয়ে গেছে? কিন্তু তাই বলে? অনেক চিন্তা করে দেখেছে এই ভাবনাটাও বিশেষ যুত পাচ্ছে নাএই লেখার উপর সবারই কমবেশি রাগ আছে  সেটা জানে বিশেষ করে স্ত্রী কমলিনী কি অলুক্ষণে কান্ড শুরু হল আসলে সংসার ধর্ম কি আর লেখক, শিল্পীদের মানায়? রীতি নিয়ম মেনে পা ফ্যালা সময়ে গুচ্ছের কাজ করা পোষায় না অবিনাশের তাও চলে যেতো যদি না দুম করে সেন্ট্রালের চাকরিটা না ছাড়তো ঠিক বিয়ের ছ'মাসের মাথায় আসলে বাবা মারা যাওয়ার পর অবিনাশের চাকরি সহজেই হয়েছিলকিন্তু নিয়তিকে খণ্ডাবে কে? মাথার মধ্যে দিনরাত কিলবিল করে পোকা লেখার পোকা আর সেই কিলবিল যদি একবার শুরু হয়েছে, উগরে না দেওয়া অবধি শান্তি কোথায়? একদিন তেমনি একটা গল্পের প্লট আবছাভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল মাথার চারপাশে অফিস আওয়ার্সেবছর শেষের ফাইল খুলে দিব্যি কাঠামোটা লিখেও ফেলেছিলদুদিন পর জোর তলব আসে বড় স্যারের ঘর থেকেকাজে গাফিলতি, তিনি নোটিশ করেছেন অনেক আগে থেকেই এখন সতর্ক করে দিতে চানএরপরেও এমন ভুল করলে সোজা বহিষ্কার ব্যাস, অবিনাশের মাথাতেও রোখ চেপে যায়কোনদিক না ভেবে পাল্টা মেল করে বাড়ি চলে আসে নির্দ্বিধায় সেই থেকে মনোমানিল্য ঘরের মানুষের সঙ্গে কমলিনীর মাথায় হাত পরে অবিনাশ তখন থেকেই ঠিক করে ঘরে বসে লেখালিখি করবেআর কেরানিগিরি করা পোষাচ্ছে নাকিন্তু এসব কথা আর কে শোনে? গিন্নি সেই যে মুখ ভারআজ পঞ্চান্নতেও তার ঈষৎ পরিবর্তন হয়নি
এই ব্যাপারটা যে একটু খোলাখুলি কারুর সঙ্গে আলোচনা করবে তার উপায় কোথায়? চায়ের দোকানে তপনের সঙ্গে আড্ডা চলে ছুটির দিনগুলোয় সেদিন দোকান কিছুটা ফাঁকা হতে তখনই প্রসঙ্গটা তুলেছিল অবিনাশআর শুনে তপন তুড়ি মেরে হেসে উঠেছিলবলেছিল- "এ তোর মনের ভুলজমাটিয়া ভূতের গপ্পো লিখছিস, এসব তারই ফলকোনদিন বলবি এসে হ্যাঁ রে তপন, আমার মুন্ডুটা দেখতে পাচ্ছিস তো?" গলার স্বর একটু জোরে থাকায় পাশে বসা এক ছোকরাও হেসে উঠেছিল বলেছিল,
'বলেন কি অবিনাশকাকু? আপনি ল্যাপটপ ছেড়ে উঠলেই লেখা হয়? এত রীতিমত মিডিয়া ডেকে দেখাবার মত খবর'
বেজায় মাথা গরম নিয়ে ফিরে আসতেই সেই সন্ধেবেলাতেই তৃতীয়বার আবার ঘটেছিল ঘটনাটা একটু গুছিয়ে সবে আমন্ত্রিত গল্পের অনলাইন লিখেছেকমলিনী রান্নাঘর থেকে ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল,
'আর কত আড্ডা দেবে? মুরোদ নেই সংসার করেছিলে কেন? চা খাবে? চা পাতা একসপ্তাহ হল ফুরিয়েছে সে খেয়াল আছে? নাও আজ শুধু জলগরম খাও বসে না থেকে নিয়ে যাও' রান্নাঘর থেকেই চায়ের কাপের জোর আওয়াজ শুনেছিলগিন্নির রাগ কমাতে টেবিল ছেড়ে পড়িমরি করে উঠে গেছিলআর তারপরেই... এটুকু সময়ে? হাতে গুনলে এক দু সেকেন্ডএকটা ঝকঝকে বাংলা লাইনের পাশে গোটা একটা ইংরেজি লেটার গজাল কিকরে? কান মাথা দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছিলবেশ মনে আছে আগের দুদিন লেখা ছিল ইংরেজি হরফে 'T' তারপরের দিনU' আর আজ 'N', হচ্ছেটা কী? কমলিনীকে বলেও উপায় নেই এদিক ওদিক ভালোকরে ঘুরে দ্যাখে ঘরটা নাহ, কোনো কোত্থাও কেউ নেই ছানাপোনাও হয়নি যে তারা কোনোরকম উৎপাত করবে পরিবারের সদস্য বলতে অবিনাশ, কমলিনী আর একটি অতি আদুরে পোষ্য ভাবতে ভাবতে মাথা ঝিম ঝিম করতে শুরু করেকিছুই যখন মাথায় ঢোকে না তখন লেখা বন্ধ করে খবরের কাগজ খুলে বসেএপাতা ওপাতা করার পর হঠাৎ দেশ-বিদেশের পাতার নিচের দিকের খবরটায় চোখ আটকে গেলএলোমেলো মাথায় কোনোরকমে চোখ বোলাচ্ছিল খবরগুলোয় তেমনই একটা খবর"...WAIS টেস্টের মাধ্যমে ভাইরাল কমপ্রিহেনশন, পার্সেপুরাল অর্গানিজেস্শন, ওয়ার্কিং মেমোরি, প্রসেসিং স্পিড প্রায় ২% মানুষের সঙ্গে মিলে যায় এই পোষ্যের...৩০০মিলিয়ন নিউরন, নার্ভসেল কুকুরের থেকেও অনেক গুণ সজাগ...!" লেখা ছিল আরো অনেক কিছুই তখন আর তেমন কিছু মনে হয়নি মাথাটা এতটাই ঘোঁট পাকিয়েছিললেখাটা মাঝপথে ছেড়েই শুয়ে পড়েছিল সেদিনের মত

কিন্তু এত সহজে মাথা ব্যাথা সারেনি অবিনাশেরঠিক একসপ্তাহ পরেসাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘটে যায়সন্তানাদি নেই ঠিকই কিন্তু কমলিনীর আদুরে পোষ্যটা সাদা-হলুদ বেড়ালটা আজকাল বড়ই উৎপাত শুরু করেছে বিছানা, রান্নাঘর, ছাদের ঘর সবজায়গাতেই ওর অবাধ আনাগোনা তুক তুক করে ডাকলে শুধু জুলজুল করে দেখেকিছুতেই ল্যাপটপ ছেড়ে যায় নাআজকাল আবার সুযোগ পেলেই বিছানা ছেড়ে ল্যাপটপের ওপর গিয়ে বসছে অবিনাশ রাগ করে নাতবে গত 'দিনের চাপে মাথাটা ধরেছিলসম্পাদক তাড়া দিচ্ছে আমন্ত্রিত গল্পটা শেষ তো করতে হবেল্যাপটপ চালিয়ে একটু বাথরুম সারতে গিয়েছিলএসে দেখে মেনিটা প্রায় ল্যাপটপের কিবোর্ডে চেপে বসেছে আলতো করে ডাকে অবিনাশ অবিনাশের ডাকে পিটপিটে চোখে মুচকি হাসে যেন বিড়ালটিআর চোখের সামনে ঘটে যায় এক অবিশ্বাস্য! সাদা-হলুদ বিড়ালটি আড়মোড়া ভেঙে নীচে নামার জন্য পা এগোয়..আর ওর থাবা চাপ দ্যায় আলাদা রাখা কিবোর্ডে- ল্যাপটপে ফুটে ওঠে আরেকটি ইংরেজি অক্ষর 'U'
আর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুত ঝিলিকের মত স্পষ্ট হয়ে যায় একটা ব্যাপার আগের তিনদিনের একে একে ইংরেজি অক্ষরগুলো ছিল 'T', 'U', 'N' আর আজ 'U'
পুরো শব্দটা যদি জোড়া যায় তাহলে দাঁড়ায় 'TUNU'!
মানে টুনু?
অবিনাশরা তো ওই নামেই ডাকে ওকে



(সমাপ্ত)




গল্পটি শুনতে চাইলে নিচের লিংক এ ক্লিক করুন


Comments

Popular posts from this blog

‘জায়গাটার নাম ম্যাজিক’

"মৃত্যুর ডাক"

বসন্ত আসেছিল তাদেরও মনে । গল্পের নাম - "রাজা,রানী ও সিপাহী"