পুতুল খুঁজতে খুঁজতে



পুতুল ওর ভারী পছন্দের তো এতে আর এমনকি ব্যাপার? ব্যাপার আছে যে সে পুতুল হলে হবে না যে পুতুল একটু মানুষ মানুষ যার চোখ জ্যান্ত জ্যান্তঠোঁট জোড়া চন্দ্রবিন্দুর মত হাসি মাথা ভর্তি কোঁচকানো চুল নরম নরম নিখুঁত হাত-পা সেই পুতুল- ওর চাই আর তাই নিয়েই আজ ওর মন কালো
এতক্ষণ তো ওর নাম- বলা হয়নি তোমাদের
হলপকো’;
সারাক্ষণ পক পক করে হাঁসের মত কথা বলত বলে দিদিমা ওর নাম রেখেছেপকো সেই পকো- আজ মুখ ফুলিয়ে বিছানার কোণে নিজেকে গুটিয়ে বসে রয়েছে কেউ কাছে গেলেই দুই চোখ দিয়ে গঙ্গা-যমুনা বের করে একাকার করছে
ব্যাপার কি?
তথ্যানুসন্ধানে যেটুকু বোঝা গেল; ‘পকোআজ রথের মেলায় পুতুল কিনতে যেতে পারছে না ভেজা মনের কারণ অনেকটা এটাই আরও একটু পরিষ্কার করা যাক
আজ রথ প্রতিবছরের মত এবারও সেই সকাল থেকে নন-স্টপ বৃষ্টি হয়ে চলেছে; ওদিকে পাড়ায় মেলা বসে গেছে নাগরদোলা থেকে কটকটি খেলনা, বুড়ির মাথা থেকে খেলনা-বাটির পসরা, জিলিপি থেকে চূড়ো করা কাঠবাদাম কি নেই ওখানে? আর? আরপকো সবচেয়ে প্রিয় যে পুতুলের দোকান ওটাও নিশ্চয়ই বসেছে সর্বনেশে বৃষ্টি থামার নামই নেই সকাল থেকে কত প্রার্থনা করেছে ভেবেছিল দুপুরে ঘুম থেকে উঠে অন্ততঃ আকাশ পরিষ্কার দেখবে তা আর হল কই? আকাশ এখনও ছাই লেপা শিরশিরে হাওয়ায় এলোমেলো বৃষ্টির ঝাপটা জানলার পাল্লা ভিজিয়েই চলেছে বাপি হাজারবার বলছে,
আরে মেলা তো একসপ্তাহ চলবে তুই মন খারাপ করছিস কেন?’
বড়রা অমন বলে কিন্তু পকো মনে মনে ভালরকম জানে আজ রবিবার এক সপ্তাহ মেলা থাকলেও শুরুর দিনের মজাটাই আলাদা ওইদিনই সবাই যায় সে যতই ভিড় হোক সেরা সেরা পুতুলগুলো তো দোকানের প্রথম তাকেই থাকে তারপর দিন যত গড়ায়, মেলার খরিদ্দারি তত বাড়ে সবাই যে যার মত বেছে তুলে নেয় ঝকঝকে সব পুতুল ওর জন্য আর কিছুই থাকবে না আর সত্যি কথা বলতে কী, পুতুলগুলোও যত মেলা এগোয় কেমন ম্যারম্যারে হয়ে যায় এর জন্য অবশ্য দোকানকাকুর ওপর রাগ হয়,
নিজেরা খায় দায়, ওদের খেতে দেয় না কেন?’
মেলায় কত যে খাবার, কিছু এনে ওদের খাওয়ানো যায় না?
সবাই বোকা পকো সার জানে সবার চোখের সামনে না হলেও ওরা সব পারে হ্যাঁ ঠিকই তো কতবার নিজের রসগোল্লার টুকরো গতবারের কেনা জেলে বউটাকে দিয়েছে স্পষ্ট মনে আছে প্রতিবারই খানিক পরে এসে দেখেছে প্লেট ফাঁকা রসগোল্লার একটু অংশও পড়ে নেই কিন্তু এসব কথা কাউকে বলার নয় কত ভেবে রেখেছিল এবার সেই পুতুলটা কিনবে গতবার কাকুটার কাছে বায়না করেও রেখেছে কাকুও মাথা নেড়েহ্যাঁবলে রেখেছে যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে কবে যে মেলায় যেতে পারবে ঠিক নেই মনে মনে টুকরো ভয়টাও দানা বাঁধছে যদি পুতুলটা আগেভাগে কেউ কিনে নেয়?
বিকেল গড়িয়ে রাত নামে মা পকো- মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে,
কাল দেখিস ঠিক রোদ উঠবে তোর বাপি সময় করতে না পারলেও আমি বিকেলের দিকে তোকে নিয়ে যাব তখন যত ইচ্ছে পুতুল কিনিস রথের দিন বৃষ্টি হয় মা মন খারাপ করতে নেই তোর দিদিও তো ইসকনের রথ দেখবে বলে বসে ছিলবেরোনোই হল না
মায়ের কথা শুনতে শুনতে পকো- চোখদুটো ভীষণরকম জ্বালা জ্বালা করতে শুরু করে আর চেয়ে থাকতে পারে নামায়ের বুকে মুখ গুঁজে প্রাণ ভরে গন্ধ নেয় মনে মনে বলে,
তোমার কথা যেন সত্যি হয় মা যত ইচ্ছে নয়, আমার একটা ইচ্ছেই যেন পূরণ হয়।‘
কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলএটাই সেই দোকান সাদামাটা মোটা বাঁশের ফ্রেমে রংচটা ত্রিপল ঘেরা; দোকানের একদিক খোলা বাকি তিনদিক বন্ধ সেখানে চার থেকে পাঁচটা করে তাক আর সেই তাকেই থরে থরে সাজানো পৃথিবীর সেরা সেরা আশ্চর্য সব মাটির পুতুল থুড়ি ওদের পুতুল বলতে নারাজ পকো ওরা তো ওর বন্ধু ওরাই তো মনখারাপের সঙ্গী খুশির ভাগিদারও বটে
পকো নিজের চোখ দুটোকে চরকির মত সারা দোকানে ঘোরায় কোথাও খুঁজে পায়না ঐরকম …; মন ছটফটিয়ে ওঠে ধৈর্য্য রাখতে না পেরে দোকানের ভিড় ঠেলে গলিয়ে দেয় নিজের ছোট্ট শরীরটা বলে,
কাকু, এনেছ? তুমি যে আমাকে কথা দিয়েছিলে? তোমাকে যে কতবার বলেছিলাম?’
কথাকটা বলতে বলতেই গলা ধরে আসে ওর শরীর থমথমে হয়ে যায়
ওমা তাই আবার হয় নাকি? দেখো দেখি কাঁদছ কেন মা?’
একগাল হেসে পকো- কাছে এগিয়ে আসেন বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রলোক সম্ভবতঃ উনিই দোকানদার তবে দোকানদার না বলে পকো- বাপি বলেন,
ওনার নাম শিল্পী শিল্পীর কোনও নাম হয় না শিল্পীর পরিচয় ওনার হাতের পরশ প্রাণের ছোঁয়া প্রাণের ছোঁয়া না থাকলে কি আর অমন পুতুল গড়া যায়?’
বাপির সঙ্গে যখন দোকান কাকুটা গল্প করত তখনই শুনেছিল কাকুটা কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিতে থাকেন পুতুল গড়েন আর সারাবছর মেলায় মেলায় ঘুরে ঘুরে সেইসব পুতুল পৌঁছে দেন শহুরে মানুষের কাছে উনি বলেন,
ভগবান যেমন মানুষ গড়েন আমিও ওদের গড়ি
পকো- ভাবনা তাহলে সঠিক মানুষের প্রাণ থাকলে ওদেরও তো থাকবে
দোকানের ছেলেটাকে খরিদ্দারদের সামলাতে দিয়ে কাকুটা হাতের ইশারায়পকোকে ডাকেন দোকানের পাশের ফাঁকা জায়গাটায় বলেন,
চোখ বোজো তোমিটিমিটি হাসতে থাকেন
পকো- খুশি আর দেখে কে? মনে হচ্ছিল এক্ষুণি বুঝি বুকের দুপদাপ আওয়াজ করা হৃদপিন্ডটা হাতে বেরিয়ে আসবে
পকো চোখ বুজিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় লোকটার দিকে
কয়েক সেকেন্ড
বেশ মালুম হয় তার দুই ছোট্ট হাতের তালু জুড়ে মোলায়েম একটা কিছু ছুঁয়ে তর সয়নি চোখ খুলেই অদ্ভুতভাবে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল শরীরটা
ঠিক যেমনটা বলেছিল তেমনটাই
মানুষ মানুষ চোখ জ্যান্ত জ্যান্ত ঠোঁট জোড়া চন্দ্রবিন্দুর মত হাসি মাথা ভর্তি কোঁচকানো চুল নরম নরম নিখুঁত নিখুঁত হাত-পা
একটা মিষ্টি ছেলে পুতুল
মনে হচ্ছে যেকোনো সময় কথা বলে উঠবে
কি পছন্দ তো?’
কাকু ডাকতেই চমকে ওঠে পকো সামান্য নড়া খেতেই পুতুলটা ওর হাত থেকে আচমকাই ছিটকে সটান মাটিতে আছড়ে পড়ে চুর চুর হয়ে যায় পুতুলের পিঠের দিকটা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে পকো মনে হয় কে যেন জড়িয়ে ধরে আছে ওকে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে চোখ মেলে তাকায় সকাল হয়ে গেছে দেখে পাশে মা
কি রে পকো? স্বপ্ন দেখছিলি? কাঁদছিস কেন? ... এদিকে বৃষ্টির শেষ নেই কোমর অবধি জল জমে গেছে আজ তোর বাপি বাজারেও বেরোতে পারেনি
ঠিক সেই মুহূর্তে পকো- মনে হচ্ছিল মা খারাপ বাপি খারাপ ওই কাকুটা খারাপ সব্বাই সব্বাই ওকে কষ্ট দিচ্ছে
বিছানা ছেড়ে উঠে জানলা দিয়ে দেখেছিল অবিরাম বৃষ্টি হয়েই চলেছে
আর ওদের পাড়ারকালিবলে কুকুরটা ভিজে চুপচুপে হয়ে কেঁউ কেঁউ করতে করতে ওর বাচ্চাটাকে নিয়ে ঠিক ওদের একতলায় এসে আশ্রয় নিচ্ছে



মা রথ কবে গো?’
দাঁড়া ঠিক মনে নেই পাঁজি দেখতে হবে
ফোনটা রেখে আনমনা হয়ে যায় উর্বি কলকাতা যাওয়া হয় না বছর চারেক হল ব্যস্ততা যেমন বেড়েছে সময় কমেছে তেমন তার ওপর যাতায়াতের ঝক্কিটাই বা কম কি?
এই রে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে গেছে গত চার-পাঁচদিন থেকেই থেকেই ঝেঁপে ঝেঁপে বৃষ্টি আসছে আষাঢ় যে এসে গেছে সেটা আকাশের দুস্টুমি দেখলেই আন্দাজ করা যায় ইশ জামাকাপড়গুলো এই মেলল দৌড়ে ছাদে যায় কাপড় অবধি পৌঁছতে না পৌঁছতে বৃষ্টিতে ভিজেই গেল ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে একে হিলি এরিয়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সূঁচের মত গায়ে আটকে স্বামীর কাজের দৌলতে আপাততঃ পুনে পোস্টিং হিল্লি দিল্লি ঘুরেই যাচ্ছে সেই বিয়ের পর থেকেই;
মাম্মাম…’ ঘরে এসে বিছানার কাছে দাঁড়াতেই চোখ বুজেই আড়মোড়া ভাঙে ছোট্ট শরীরটা
ঠিক বুঝতে পেরেছে ব্যাটামা পাশে নেই
কাপড় বদলে এসেই কোলে তুলে নেয় উর্বি
যেমনটা চেয়েছিল, তেমনই;
‘… চোখ জোড়া জ্যান্ত জ্যান্ত ঠোঁট জোড়া চন্দ্রবিন্দুর মত হাসি মাথা ভর্তি কোঁচকানো চুল নরম নরম নিখুঁত হাত পা
ওর ছেলেপকাই ভাল নাম একটা অবশ্য আছে তবে এই নামটাই বড় আদুরে বড় কাছের
পকো- ছেলে পকাই এই দেড় বছরে যা পকপক শুরু করেছে পকো তিন বছরেও এত কথা বলেনি পাকা বুড়ো একটা
মনে পড়ে যাচ্ছে ২৫বছর আগের একটা দিন
সেই বৃষ্টি সেই মেঘলা সেই মনখারাপ
একটা মনখারাপের স্বপ্ন হ্যাঁ ওটা স্বপ্নই ছিল কিন্তু তাও কেন জানে না স্বপ্নে বাস্তবের টুকরো সত্যি হয়ে থেকে গেছিল সে বছরে বৃষ্টির দাপটে রথের মেলা আর হয়নি এমনকি পরেরবছরগুলোতেও ঘূর্ণির সেই কাকুটাকে আর খুঁজে পায়নি পকো মাটির পুতুলের দোকান ঠিকই আসত কিন্তু কাকুটা যেন কোথায় ভোজবাজির মত হারিয়ে গেছিল
গোটা ছেলেবেলায় হাজার মজার মাঝেও উর্বির সেই ইচ্ছেটা কেউই পূরণ করতে পারেনি পারেনি পকো- মনের ঝাপসা দাগ মুছতে ঢের ঢের মাটির পুতুলে ঘর ভরে উঠেছে তবু কারুর আশায় সেই শূন্যস্থানটা ফাঁকাই রয়ে গেছে
আচ্ছা ওই কাকুটার মত পকোও কি পুতুল গড়তে শিখে গেছে?
হ্যাঁ পকাই তো ওর পুতুল-
ওর আদরের ধন
প্রাণের কাছাকাছি
স্বপ্নে দেখা সেই রাজপুত্তুর আজ ওর দুহাতের মাঝে ওর বুকের মধ্যে
কলকাতা থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে আজ এখানে রথ নেই মেলা বসা তো দুরস্থ
তবু সেই স্বপ্ন আছে;
আর আছে একটা ফুটফুটে জ্যান্ত সত্যি
বন্ধ কাঁচের জানলার ওপারে ঠুক করে একটা শব্দ হয়; বাইরের জানলার বিটে উড়ে এসে বসেছে একটা পাখি শালিখটা ভিজে চুপচুপে হয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে আর তার ডানার আড়াল থেকে জড়োসড়ো হয়ে উঁকি দিচ্ছে একটা পুচকে শালিখ

(আমার এই স্বপ্ন তাদের জন্য যাঁরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে স্বপ্ন ছুঁতে ভালোবাসে কিন্তু অনেকসময়ই স্বপ্ন ছোঁয়ার বুঁদে মুহূর্তে মনখারাপ ঘিরে ধরে
দরকার বিশ্বাস, টুকরো আশা আর অনেকখানি মনের জোর
এটুকু থাকলেই জীবনে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নেরা একেক করে জুড়ে যায়, জীবনপথেই
খুঁজে দেখো;
পকোতোমাদেরই কেউ একজন)



(সমাপ্ত)






Comments

Popular posts from this blog

‘জায়গাটার নাম ম্যাজিক’

"মৃত্যুর ডাক"

বসন্ত আসেছিল তাদেরও মনে । গল্পের নাম - "রাজা,রানী ও সিপাহী"