"টাকার কুমীর"
ছোটবেলা থেকে কি এক স্বভাবদোষে দু-হাত সারাক্ষণ মুঠো করে থাকত বিপু। মানে বিপুল ব্যানার্জী। ওই যে দক্ষিণ-চব্বিশ পরগণায় চৌধুরীদের বাড়ি। তার ঠিক বাঁ-দিকেই
এ তল্লাটের একমাত্র কেরোসিন ব্যবসায়ী সনাতনের বাড়ি। ওরই একমাত্র
বংশজ বিপু। একমাত্র এই কারণে বলা যে চারবোন
আর একভাই সনাতনের এপিঠ ওপিঠ মিলিয়ে, কন্যাসন্তানের
বাড়বাড়ন্ত। পুত্র বলতে ওই একটাই! এসব নিয়ে আশেপাশের অতি উৎসাহী মানুষ চোখ টাটায় বইকি! এত বড় রেশন দোকান, ব্ল্যাকে
চড়া দামে কেরোসিন তেল বিক্রি। ইদানিং সে যে সুদের কারবারও শুরু করেছে তা আর কারুর
অজানা নেই। কয়েকদিনে গজিয়ে উঠেছে মাথা উঁচু
দোতলাও। পেল্লায় বাড়ির রকমসকম দেখতে দেখতে
পথ চলে গাঁয়ের খুড়ো, জ্যাঠারা। অবাকও হয়! সে
না হয় হল, আমাদের গপ্পোটা সনাতনকে নিয়ে নয়, ওর সুপুত্র বিপুকে নিয়ে। বিপুর উপর সবার নজর তাতো আগেই বলেছি। ওর মুঠো স্বভাবের জন্য কেউ বলে বিপু বড় হলে মারকুটে
হবে, কেউ আবার গালে হাত দিয়ে বলে "জানো বিপুর মা তোমার ছেলে বাপের চেয়েও বেশি কামাবে!" তা হলেই বা কি আর না হলেই বা কি! হাজার হোক, মায়ের
মন তো! বিপুর মা মনে মনে ঠাকুর ডেকে বলে-" টাকা আমার চাই না ঠাকুর! ছেলেটার
যেন কঠিন কোনো রোগ না হয়! তুমি দেখো ঠাকুর!" আদ্যাস্ত্রোত্র
পাঠ করে মাথা খুঁড়ে পূজোও দেয় দক্ষিণাকালীর মন্দিরে। ভয় হয়, কেউ
আবার ছেলেটাকে বাণ মারেনি তো! যা
সব চোখ! হিংসেয় মানুষ কত কিনা করে!
আস্তে আস্তে বিপু বড় হয়! কিন্তু ছোট্টবেলার সেই মুঠোরোগের কোনো পরিবর্তন হয় না! বয়স
বাড়ে। বন্ধু- বান্ধবের হাসি ঠাট্টাও শোনে! তবু মুঠো সে খোলে না। কোনোমতে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে সোজা গিয়ে বসে বাপের
গদিতে। বাপ-মার দেওয়া নামটাও কেমন যেন মিলে গেল সময়ে সময়ে। ব্যবসার আতিপাতি ঘেঁটে অল্প দিনেই বিপুল রমরমা আনল
যেমন, অন্যদিকে লক্ষ্মী জুয়েলার্সের মালিক অধর সরকারও যোগাযোগ করে ফেললেন ব্যানার্জি পরিবারের
সঙ্গে। এমন ছেলে পাওয়া দুষ্কর। সারাজীবনের জন্য নিশ্চিন্তি। কমলাকে একবার যদি পছন্দ করে ফ্যালে ওরা! তাহলে জুহুরী অধরের নাম, মান দুটোই থাকে! ভাবামাত্র-ই কাজ!
ব্যানার্জি বাড়ির মত না হলেও অধরবাবুর বাড়বাড়ন্ত কম ছিল না। আপত্তির তাই বিশেষ কোনো কারণ খুঁজে পায়নি সনাতন। পাত্রের মন পড়েছিল সুন্দরী কমলার দিকেও। দেরি হয়নি। ধুমধাম করে, এ
ওর টাকার গরম দেখিয়ে ব্যান্ড বাজা বারাত নিয়ে বিপু, কমলার
চারহাত এক হয়! বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ঘর আলো করে
ছেলে, পরে মেয়েও হয়! সময়ের
সঙ্গে সঙ্গে তারাও বড় হতে থাকে! বেশ
চলছিল। সময় কি আর থেমে থাকে? বিপু বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিজের গিন্নিকে বশে রাখলেও, ছেলেমেয়ের পাল্লায় পড়ে নাভিশ্বাস উঠছে! ছোটখাটো চড়ুইভাতি তো দূরের কথা, বউকে একখান ছাপা শাড়ি দিতেও হিসেবের খাতার পাতা ওল্টায়
বিপু। যা কিছু নোট সাজিয়ে গুছিয়ে বালিশের
তলায় রাখতেই কি যে পরম শান্তি তা কি আর বলে বোঝাতে পারে বিপু।
খরচ করলেই তো সব শেষ। টাকা
গন্ধটাই অনেকটা যেন বিরিয়ানির মত উৎকৃষ্ট। এমনকি
টাকার চকচকে ভাব যে লোকের গায়ে লেপ্টে থাকে সে লোক যতই আহাম্মক হোক, বিপু তার ষোল আনাই
ভালো দেখে। সে মানুষ খারাপ হতেই পারে না।
মেয়ে শ্যামা আর ছেলে শ্রবণ মোটেই তোয়াক্কা করে না এসবের। বাবার মুঠো খুলে মুঠোফোন নেবার উপায় করতে শুরু করল তারা।
দোকান খোলা থেকে দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত বাবার চারপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। কলেজের শহুরে বন্ধুদের দেখাদেখি আদবকায়দাও শিখল ওদেরই মতন! অমুক দামি খাবার টিফিনে দিতে হবে! অমুক টুর্নামেন্টে ওই কোম্পানির স্পোর্টস শু লাগবে! কালিপুজোয় আকাশ জোড়া বাজি ফোটাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিপু বেজায় বিরক্ত। জেরবার হয়ে যাচ্ছে এদের জ্বালায়! এত কষ্ট করে জমানো টাকাপয়সা তলানিতে এসে ঠেকবে নাকি? দুশ্চিন্তায় কালো চুলে পাক ধরেছে বিপুর। রাতের ঘুম পালাচ্ছে চোখ থেকে। সারাক্ষণ কেমন যেন এক অস্থিরতা! কাজকম্ম, হিসেব
নিকেশে বসলেও মেজাজ সপ্তমে থাকে! কাজের
লোক থেকে বাড়ির লোক সকলেই তটস্থ! কমলাকে
চুপ থাকতে দেখে ছেলেমেয়েও রাগ করে মনে মনে!
হটাৎ বিপুর একটা ফন্দি আসে মাথায়! কাক পক্ষীও যেন টের না পায় তার অভিসন্ধি। কমলাও নয়।
ভাবে, সুযোগটা
নিতে হবে সবাই যখন ঘুমাবে তখনই। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিপু চুপি চুপি খাট থেকে
নেমে যায় মাঝরাতে। নিঃশব্দে
খোলে সদরের দরজা। মাঝে
মাঝে কমলার পোষা মেনিটা ম্যাওঁ করে ওঠে, সেও
ভাবে হয়ত রাত-দুপুরে মালিক চলল কোথায়? বিপুর সেসব দেখার ফুরসৎ নেই। হনহনিয়ে এগিয়ে যায় পিছনের বাগানের দিকে! আম, লিচু
গাছের মাঝে বেছে নেয় পছন্দমত একটা জায়গা। তারপর কোদাল দিয়ে এক, দুই, তিন
কোপে শুরু করে খোঁড়া। কসরৎ
করতে হয়! হলে কি হবে, বিপুর
মন মেজাজ এক অদ্ভূত আনন্দে চকচক করে ওঠে! প্রথম
কয়েক দিন বেশ ঝঞ্ঝাট বিহীন কেটেছিল। কিকরে যেন কমলা টের পেয়ে যায়! বুঝুগ গে! মেয়েমানুষকে
তেমন পরোয়া কোনোদিনই করেনি, আজও
করে না বিপু! আরে বাবা, সবই
তো করছে এই সংসারের জন্য! কমলা
ঠিক তক্কে তক্কে থাকে, অন্ধকারে চৌকাঠ পেরোতে গেলেই অমনি
তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে পড়ে, বলে, "কিগো ব্যাপার কি! এত
রাতে কোথায় যাচ্ছ তুমি?" হাজার ফ্যাচ ফ্যাচ শুরু করে দেয়। বিপুর কান ব্যথা হয়ে যায়! গা গতরে কম পরিশ্রম তো হচ্ছে না! আরাম
পেতে চায় শরীর! কিন্তু থামলে যে চলবে না! মাথা খাটিয়ে ধুনি সমাদ্দারের ২-৪জন ঠিকা মজুরকে জোগাড় করে! গরিব মানুষ! পেটের
দায়! দু'পয়সায়
রাজিও হয়ে যায় তারা! কিন্তু ঘটনা, রটনা হয়ে গেল এক পক্ষ যেতে না যেতেই! নিলি বৌদি, সুশীলা
খুড়ি বলতে শুরু করে- "বিপু
নিশ্চয়ই কোনো গুপ্তধন পেয়েছে! সেসব
সবাইকে লুকিয়ে পাতালে সিঁধোচ্ছে! ধর্মে
সইবে না! মা মনসা ঠিক দেখবেন! মানুষকে
শুষে ওর বাপ দাদা পয়সা বানিয়েছে!" ঘুরে
বেড়ানো বখাটে ছেলেগুলো বলতে শুরু করে- "বিপু
বুড়োর ভীমরতি হয়েছে!" বিপু
শোনে আর হাসে। আবার
কেউ বলে "এ বুড়ো শালা যক্ষ হবে, তাই সব সম্পত্তি পুঁতে রাখছে যাতে কেউ নিতে
না পারে!" কথাগুলো এককান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দ্যায়! সেদিন কোদাল কুপিয়ে যে কাজটা শুরু করেছিল, সে কাজ ক্রমে ক্রমে আরো, আরো এগোতে থাকে!
(বেশ কিছুদিন পরে)
বিপু এখন দিব্বি ঘুরে বেড়ায় জলের চারপাশে। কখনো আবার জলে নেমে বসে থাকে ঘন্টা খানেক। সাড়া পড়ে গেছে পুরো ফতেপুরে। হই হই করে আসছে বাচ্চা থেকে বুড়ো। আধাশহর দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ফতেপুরের ছেলেমেয়েরা শহুরে
হতে চাইছে! নিজের ছেলেমেয়েকে দেখে সেটা ঢের
বুঝেছিল বিপু। আজকাল
পানাপুকুর বিলে সাঁতার কাটতেই চায় না ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা।
তাই একখানা বেশ বড়সড় মাপের সুইমিং পুল বানিয়েছে। টাকাও আসছে দেদার।
যেটুকু ঘাটতি করছে নিজের ছেলেমেয়েরা। পূরণ তো করতে হবে। বিপুর এই বেড়ে বুদ্ধিখানা শোরগোল ফেলে দিয়েছে। দলে দলে সাঁতার কাটতে আসছে উৎসাহী লোকজন। এমনকি আশেপাশের গাঁ থেকেও। ইতিমধ্যে অশুলও হয়েছে লাভের পাঁচগুণ। রগরগে টাকা রোজগারে বেড়েছে আরো শত্রু! কমলা ভাবে, এমনতরো
মনোভাব হওয়ার কারণ কি কর্তার! এ
যেন এক নতুন বিপত্তি! গুপ্তধন পেয়েছে বলে যাদের সন্দেহ
চরমে ছিল তারাও অন্য ভাবনা শুরু করে! হয়তো
বা পুলের তলাতেই পোঁতা আছে ঘড়া ঘড়া মোহর! তাই
হয়ত বিপু পুল ছেড়ে নড়ে না। ঘরে
যাওয়া তো দুরস্থ! দুঃখ করে কমলা। মানত করে মাদুলি তাবিজ পড়ায় কত্তাকে। কেঁদে কেটে একসা হয় বাপের বাড়ি গিয়ে! তান্ত্রিক, জ্যোতিষী, বাদ দেয় না কিছুই। তারাও সুযোগ বুঝে লুটে নেয় কলা, মূলো থেকে টাকা, গয়না। আশ্বাস দেয় কর্তার সুমতি হবে ঠিক!
কিন্তু সমস্যা যে কে সেই! বিপু আর শান্তি পায় না। ঘুম তো ছিলই না। কিছুদিন যাবত শরীর জুড়ে শুরু হয়েছে অসহ্য চুলকানি। মুখ হাত-পা
শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চুলকাচ্ছে।
অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য কি? জলে ডুবে বসে থাকলেও কোনোরকম আরাম বোধ করছে না। ঠিক কি যে হচ্ছে বিপু বুঝতে পারছে না।
ওর যদি একটা কিছু হয়ে যায় সমস্তটা সামলাবে কে?
একদিন যন্ত্রণাটা অসহ্য হয়ে ওঠে। উঠে বসে মাঝরাতে। ঘরের আলো জ্বালালে কমলা উঠে পড়বে! তাই বিছানা ছেড়ে কোনোমতে বাথরুমের দিকে দৌড়োয় বিপু! আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজেকে ভালো করে দেখে। এটা
কি? আঁতকে ওঠে বিপু। লাইট জ্বালাতেই নিজের চোখে, নিজের মুখ আয়নায় দেখে গলা শুকিয়ে যায় ওর! স্বপ্ন দেখছে নাতো? একটু
একটু করে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে গাল, কান অন্যান্য অংশগুলো! গলার স্বর প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে! ডুমো ডুমো ফুলো ফুলো গুটির মত দানা দানা এগুলো কি? এরকম তো আগে কোনোদিন হয়নি ওর? অসহ্য জ্বালা করছে প্রত্যেকটা জায়গায়! আঙ্গুল দিতে গেলেই বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে গোটা শরীরে। ভালো করে মুখটাকে আরো খানিকটা কাছে নিয়ে গেল বিপু, আর তাতে ভয়টা শিরশির করে নেমে গেল পিঠ বেয়ে! মুখটা এমন ছুঁচলো হল কিকরে? সরু হয়ে উঁচু মনে হচ্ছে যেন! সর্বনাশ! চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছে না বিপু! কি
দমবদ্ধকর পরিস্থিতি! কি করে হল এসব? ওকে এই অবস্থায় যদি কেউ দেখে ফ্যালে! তাড়াতাড়ি করে বাড়ি থেকে বেরোতে চায় কিন্তু পারে না।
পা আটকে আসে মেঝের সঙ্গে। দরজাটা
ভিতর থেকে ছিটকিনি তুলে দেয় বিপু! হাত
এমনকি পায়ের পাতার কিছু অংশেও গুটিগুলো গা ঘেঁষাঘেষি করে বড় হচ্ছে! আরো, আরো! আচমকা কিছু একটা সুরসুর করে ওঠে পিছনের কোমরের কাছটাতে। হাত ঘুরিয়ে পিছনে নিয়ে যেতেই চমকে ওঠে বিপু! বুকের ভিতর ধড়ফড় করে। এত...! এ
কাকে দেখছে ও? বারতিনেক নিজেকে চিমটি কেটেও দেখে। কোনো স্বপ্ন নয়। কোনো
অবাস্তব নেই। ওতো সত্যি দেখছে সব? এখানে এই অবস্থায় আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না কিছুতেই! শরীর
জুড়ে তোলপাড় করছে। টলমল
করছে পায়ের পাতা! দরজাটা আলতো ফাঁক করে দেখল। ঘরের ভিতর সবাই অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কোনোমতে পা টেনে টেনে বেডরুমের দরজা ফাঁক করল। কমলাও জেগে নেই। আর
থাকতে পারছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে।
সদর খুলে পুলের দিকে পা বাড়াল ও! ম্যাওঁ করে উঠল বিড়ালটা। নিশ্চই ওকে দেখে ভয় পেয়েছে। আর একটু! এই
তো পুল এসে গেছে! বিপু পুলের সামনে এসে শরীরটাকে ভাঁজ
করে আস্তে করে নেমে গেল জলে! হাত
পা গুলো কেমন কুঁকড়ে গেছে। কিন্তু এবার বেশ আরাম লাগছে! বিপুর চোখ বুজে এল ঘুমে!
গোটা গ্রামবাসী জড়ো হয়েছে! এসেছে লোকাল থানার ওসিও। খবর দেওয়া হয়েছে বন-দপ্তরেও। কি করে এল এটা? সবজে
আর খয়েরি মেশানো বিশালাকার একটা কুমির! সবার
মাথায় হাত! এমন প্রাণী এ তল্লাটে কোনোদিন আসেনি! কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা জলময়। আর মুখ উঁচু করে করে দেখছে আশেপাশের ভিড় করা মানুষজনকে। কমলা, বিপুকে
সারা ঘরে না খুঁজে পেয়ে এদিকের গোলমাল শুনে ছুটে আসে। প্রাণীটা দেখে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঠিক আগের
মুহূর্তে দ্যাখে, কুমিরটার সামনের হাতের মত অংশগুলো
কেমন অদ্ভুতভাবে মোড়া! ঠিক যেন মুঠোর মত!
(সমাপ্ত)
Comments
Post a Comment