"মৃত্যুর ডাক"
মৃত্যুর ডাক
'তাই বলে হরিদা একেবারে ভেজ থেকে নন-ভেজ?'
'হ্যাঁ আসলে নববর্ষের গল্পটা এমনভাবে চলল। আর তার সঙ্গে পাবলিকের ডিম্যান্ড। সহকারী সম্পাদক বলল দাদা নামটা চেঞ্জ করুন চলবে
ভাল!'
'ভাবাচ্ছে মশাই। বেশ ভাবাচ্ছে। 'হাসিখুশি'র নাম পাল্টে যখন 'রাত
বারোটা' নাম হয় তখন আমার মত পাঁচমেশালি লিটিল ম্যাগের কী অবস্থা বুঝতেই পারছেন।
অমিয়বাবুর মত ক'জন লেখক আর আমাদের পত্রিকায় লিখবেন? সাম্মানিক তো তেমন করে
দিতে পারি না। অনেক কষ্টে এনাকে পেয়েছি।'
'কিন্তু কমলেশ তুমি আজ এখানে...?' কিছু একটা বলতে গিয়েও
যেন গলায় বাধছিল সম্পাদক হরিহর নাথের। কমলেশ
সঙ্গে থাকলে তো ভদ্রলোকের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনাটা করা যাবে না! মহা মুশকিল হল? অনেক
চেষ্টা চরিত্র করে স্ত্রীকে কাজের বউয়ের কাছে রেখে এসেছেন। ছেলেরা
যে যার কাজে ব্যস্ত। ঠিক
কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। অমিয়বাবু কী জেনেশুনে করছেন? মন থেকে তো কিছুতেই
বিশ্বাস হচ্ছে না। আর সত্যি সত্যি যদি নাই হয়
তাহলে তো মানুষটাকে সতর্ক করে দেওয়াও তো দরকার। কেমন যেন তালগোল পেকে যাচ্ছিল মাথার মধ্যে।
'কী হরিদা কি ভাবছেন? ও হরিদা কি হল শরীর খারাপ করছে নাকি আপনার?'
'এ্যা কী কী ডাকছ ডাকছ আমাকে?'
'ডাকছিই তো।'
'না আসলে তোমার বৌদির শরীরটাও ভাল নেই। এদিকে অমিয়বাবু সেই যে ঘরে ঢুকেছেন।
এত দেরি। আর যে বসতে পারছি না।'
'ঠিকই তো অমিয়দার বাড়ি আসা যেন শাস্তি একরকম। যা নোংরা মেলোচ্ছ জায়গা। বাড়ি গিয়ে স্নান না করা অবধি শান্তি নেই। একটা পুজোর লেখার জন্য কতবার যে ঘুর ঘুর করছি। ভাবতে পারবেন না। প্রথমে
আপনাদের পত্রিকা তারপর কচি পাতা, সবুজ মনে পরপর গল্পদুটো যেভাবে বাজার কাঁপাল তাতে এ
পুজোয় অন্ততঃ দাদার একটা অণু টনু পেলেও ধন্য।
পাড়ার ভুলুদা বলেছে কমলেশ অমিয়দার একটা গপ্পো আনো। আমিও তোমাদের
পত্রিকায় আমার ক্যাটারারের বিজ্ঞাপন ছাড়ব। বোঝেন-ই তো আমাদের অবস্থা। ভাবছি
এই হয়ত দিলেন। সামনের মাসে পাব।
কিন্তু যে কে সেই...! মুখ ফুটে নাও বলেন না।'
কমলেশবাবু বকেই যাচ্ছিলেন। তাহলে ব্যাপারটা জানে না ছেলেটা? নিশ্চয়ই জানে না।
কিন্তু অমিয় সমাদ্দারকে কথা ক'টা জিজ্ঞেস যে খুবই দরকার। খুব।'
'কিন্তু কেউ মানুক আর ছাই নাই মানুক। ভদ্দরলোকের এলেম আছে। নাহলে
পাঠকের চাহিদার সঙ্গে নিজেকে এমন করে কেউ পাল্টে ফেলতে পারে? উঁহু হু হু আর যে বসা
যাচ্ছে না হরিদা। গন্ধটা
পেয়েছেন? সেই এসে বসা থেকে পাচ্ছি। বড্ড
বেয়ারাভাবে বেড়ে চলেছে। আগেও
দু'এক বার এসে পেয়েছি। কিন্তু
আজ যেন একটু বেশিই...। আধঘন্টা হতে চলল। অমিয়বাবু
যে কোন চুলোয় গেলেন। ও অমিয়দা অমিয়দা? এদিকে
ওনাকে ফোনেও পাওয়া যায় না। মেল রিসিভ করা তো কবে ছেড়ে
দিয়েছেন! পুজো এগিয়ে আসছে। কী যে করি?'
'লোকটার গিন্নি চলে যাওয়ার পর থেকে বাড়িখানাকে এক্কেবারে নরক বানিয়ে রেখেছে।
আগে বৌদি নিজে হাতে করে দোপাটি, গাঁদা, গোলাপের চারা লাগিয়েছিল সামনের খোলা বাগানটায়। আর এখন পোড়ো বাড়ি পুরো। নাহ
নাহ...! সত্যি কমলেশ
গন্ধটা তো...! অন্নপ্রাশনের ভাত বেরিয়ে এল।'
নাকে রুমাল চেপে উঠে দাঁড়ান হরিহর নাথ। সঙ্গে কমলেশ রায়ও। দুজনের
কথাবার্তা শুনে আন্দাজ করা যাচ্ছে যে দুজনেই পত্রিকার সম্পাদক। কমলেশ রায় পুজোসংখ্যার গল্প চাইতে এলেও আরেকজন ঠিক
কেন এসেছেন স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না। তবে
হরিহর নাথ লোকটা যে বেশ দুশ্চিন্তায় এটুকু নিশ্চিত। পরিবেশ অসহনীয় হয়ে ওঠায় তাঁরা চেয়ার ছেড়ে উঠতে
যাবেন কী তেল চিটচিটে ময়লা পর্দা সরিয়ে আস্তে আস্তে ঘরে পা রাখেন এক ভদ্রলোক।
বয়স আন্দাজ ষাট কী আরেকটু বেশি হতে পারে! স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। শরীরের যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে তাতে চামড়ায় অজস্র
ভাঁজ চোখে পড়ছে। বিশ
পঁচিশ বছর কোনও ট্রাঙ্কে কাগজ বা কাপড় দলা পাকিয়ে রাখলে যেমনটা হয়! কপাল
থেকে ঘাড়ের পেছনদিক তেমনই। শ্রীহীন।
চোখে গোল গোল ঝাপসা কাঁচের ফ্রেম। ভাল করে খুঁজলেও চোখের কালো মণি দুটোকে চশমার এপার
থেকে বোঝা মুশকিল। শরীরের গড়ন দেখলে মনে হয় তিনি বহু কষ্টে হেঁটে চলে
বেড়াচ্ছেন।
'আপনার কী শরীর খারাপ অমিয়বাবু? কেমন লাগছে।'
'আপনারা ফিরে যান। যাদের যাদের কথা দিয়েছি।
আপনারা সবাই লেখা পেয়ে যাবেন!'
খুব আস্তে আস্তে কথা বলেন অমিয়বাবু।
'পেয়ে যাব? কবে? ওই তো হরিহর দা দাঁড়িয়ে ওঁর মুখ থেকেই শুনেছি নববর্ষের পত্রিকা যখন ছাপতে
যায় যায় আপনার গল্প হাতে পায় দাদা। আপনাকে মশাই আর ঠিক ভরসা হচ্ছে না।
নেহাৎ...।'
আচমকা লোকগুলো যে ঘরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার
ঠিক মাথার ওপরের সিলিংয়েই অসম্ভব ধুপধাপ শব্দ হয়। গোটা
বাড়িটায় থরথর করে ঝাঁকুনি হতে শুরু করে। সিলিং থেকে ঝুরঝুর করে বৃষ্টির মত খসে পড়ে চুন
সুরকির মিশ্রণ।
সর্বনাশ!
ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি?
অসম্ভব বিচলিত হয়ে ওপর দিকে তাকাতেই কমলেশবাবুর
ঠিক পায়ের সামনে ঝরে পড়ে একদলা সিমেন্ট। বাসটে পচা গন্ধ আর খসে পড়া চাঙ্গরের ধুলোয় হাঁচি
কাশি শুরু হয়। লাফিয়ে চার পাঁচ পা পিছিয়ে আসে কমলেশবাবু।
কী হচ্ছে ওপরে?
'বাবাগো! আরেকটু হলে মাথায় পড়ত। কী
হল অমিয়বাবু? এসব কী? লেখা নিতে এসে শেষমেষ জখম হব? ঘর
যে ভেঙে পড়ছে! এভাবে
না থেকে বিক্রি করে দিতে পারেন তো?'
অমিয়বাবু নিরুত্তর। যেন এসবে কোনও গায়-ই নেই। যেমন
শান্ত ভঙ্গিমায় নুয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তেমন
করে দাঁড়িয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলে ওঠেন,
'হরিদা। আমি
কথা রাখব। যেমন আগেও রেখে এসেছি!'
'না আসলে আমি ঠিক লেখা চাইতে...আজ।'
ততক্ষণে ভয়ানক কাশতে শুরু করেছেন কমলেশ রায়।
গায়ের ধুলো ঝেড়ে নাক চোখ মুছতে মুছতে হরিহরবাবুকে প্রায় হাত ধরে টেনে নিয়ে
বাইরে চলে আসেন তিনি। কমলেশ বাবুর বুকের মধ্যে তখনও
দুরমুশ পিটছে। সিলিংয়ের কোনও একটা ভারী চাঁই
যদি এক্ষুণি মাথায় পড়ত?
বিকেলের আকাশ গাঢ় কমলা থেকে কালচে হয়ে আসছে।
মাথার ওপর ঘুরপাক খাওয়া পাখিগুলোর ডানার রংটা ঠিক চেনা যাচ্ছে না।
নীচ থেকে দেখে আকারে কাকের তুলনায় বড় মনে হচ্ছে যেন। ওগুলো কী পাখি? পচা গন্ধটা পাতলা হয়ে এসেছে। হটাৎ বাড়ির
মেন লোহার জং ধরা গেটটা ঠেলে বাইরে বেরোতেই হরিহরবাবু কী যেন দেখে চোখ লাল করে পেট
মুচড়ে মুখে ওয়াক তুলে বসে পড়েন রাস্তার ধারে। দৌড়ে
পাশে এসে দাঁড়ান কমলেশবাবু। যা
দেখেন তাতে ওনার শরীরটাও গুলিয়ে ওঠে।
দেখেন,
একটা চেপ্টে যাওয়া বাচ্চা কুকুরের মৃত শরীর। যার চামড়ার ভেতর থেকে পাকস্থলী, হৃদপিন্ড বাইরে বেরিয়ে
লেগে রয়েছে রাস্তার চারপাশে। রক্তে
থিকথিকে মাছি এসে ভিড় করেছে। চোখদুটো বেরিয়ে ঘিলুর সঙ্গে
আটকে।
এভাবে একটা বাচ্চা কুকুর কিভাবে মারা গেল?
বড় কোনও ট্র্যাককে তো এখানে চলাচল করতে দেখা যায় না?
চটকে যাওয়া শরীরটা একনজর দেখলে বোঝা যাবে কেউ যেন আঙুল দিয়ে ঘেঁটে ঘেঁটে
কুকুরটার শরীর থেকে কিছু বের করতে চেয়েছে।
গন্ধটা কী তবে এখান থেকেই আসছিল?
*********
ঠিক একবছর আগে অমিয়বাবুর অতিথি আপ্যায়ন
এমনটা ছিল না। মানে মিশুকে বলে খুব একটা
সুখ্যাতি না থাকলেও যে ক'য়জন সম্পাদক, সাহিত্যিক, চেলা চামুন্ডে অমিয়বাবুকে
চেনেন জানেন তাঁদের প্রত্যেকেরই যাতায়াত ছিল এখানে।
লেখকের বাড়ি একটু একটেরে। নির্জন জায়গায়। কাছাকাছি
১কিমির মধ্যে তেমন বসত বাড়ি না থাকলেও দু'একটা দোকান চোখে পড়ে। হয়ত লেখালিখির সুবিধার জন্য এমন জায়গা বেছেছেন। ফাঁকা নিরিবিলিতে লেখার হাত যে খোলতাই হয় একথা তো
সবাই জানে। তবে একথাও ঠিক অমিয়বাবু নিজে
কথা না বললেও হাসিমুখে অন্যের কথা শুনতেন। বাড়িতে
লোক এলে গিন্নিকে হেঁকে বলতেন,
'কই হে কোথায় গেলে? চায়ের সঙ্গে ওই যে ওই চানাচুরটা আনো দেখি। আরে মনে পড়ছে না? পরশু যেটা বাজার থেকে
আনলাম। টক ঝাল নোনতা।'
সেসব আসরে চলত গল্পপাঠ। চলত গল্পের চুলচেরা বিচার।
আবার কখনও একে অপরকে ল্যাং মারার ফন্দিও। চিরকাল
যা বাঙালির স্বভাব।
অমিয়বাবু লেখা শুরু করেছিলেন ওনার যখন কুড়ি একুশ। কলেজ থেকে বেরিয়ে আর সরকারি দপ্তরের পরীক্ষায় উঁকি
দেননি। কী এক জেদে কলম বাগিয়ে বসেন।
শোনা যায় পারিবারিক কিসের এক ছোটখাটো ব্যবসা ছিল। তাইতেই মোটামুটি নুন ভাত জুটে যেত। একটু একটু করে হয়ে ওঠেন সবার পরিচিত 'গল্প কাকু'; ওনার গল্পে
চারপাশের ঘটনাগুলো সাজানো থাকত ছবির মত। ছোট থেকে বড় কারুরই বুঝতে অসুবিধা হত না।
গল্পের রূপ মার্জিত, সুললিত। লিখতে
থাকেন বহু প্রথম সারির পত্রিকায়। প্রথমে উত্তর কলকাতার পৈতৃক
বাড়িতে থাকলেও কিছুদিন পর এইদিকে চলে আসেন। কেন? জানা যায় নি। অনেকে কানাঘুষো করেন সম্ভবত নিঃসন্তান হওয়ার
কারণেই দম্পতি নিজেদের আড়াল করেছেন। হয়ত
আত্মীয় স্বজনের থেকে তিতিবিরক্ত হয়েই এ সিদ্ধান্ত। কে
জানে? বাড়ি, ব্যবসার কী করেছেন তাও অজানা।
কিন্তু এখানেও বাধ সাধল নিয়তি।
পৈলানের পুরোনো এককামরার দোতলা বাড়িতে থাকতে তো শুরু করেন। কিন্তু
দু'বছরের মাথাতেই অঘটনটা ঘটে যায়।
অমিয়বাবুর স্ত্রী মারা যান। বাড়িতে এলে তালাবন্ধ। ফোনের
পর ফোন করেও তাঁকে আর পাওয়া যেত না। যোগাযোগ
বিচ্ছিন্ন করে দেন সবার সঙ্গে।
পুরো একটা বছর আটকা ছিলেন ঘরে। একা। সবার
চোখের আড়ালে।
তারপর একদিন হঠাৎই 'হাসিখুশির' দপ্তরে ফোন করে বলেন,
'হরিদা আমি একটা গল্প লিখেছি। নেবেন?'
হরিহর নাথ হাতের চাঁদ পেয়েছিলেন। ইদানিং
লেখকদের মধ্যে ধৈর্য্য ও পড়াশুনা দুয়েরই অনেক ফাঁক থাকে। আগেকার
সেই জ্ঞান কোথায়? চটক থাকলেও গভীরতা নেই। অমিয়বাবু
অবশ্য বরাবরই সে গোত্রে পড়েন না। যেমন তাঁর সহজ ভাষা, তেমন প্লটের গভীরতা।
সেটাই এতদিন খামতি ছিল পত্রিকায়।
আনন্দে তুতলে বলে উঠেছিলেন হরিহরবাবু,
'হ্যাঁ হ্যাঁ নেব না কেন? নিশ্চয়ই নেব। সামনে নববর্ষ।
এ সময় যে কী উপকার করলেন। ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন, নববর্ষের স্পেশাল
সংখ্যায় আপনার গল্প থাকবে। আমি আজই ফেসবুকে বিজ্ঞাপন
দিচ্ছি!'
হরিহর নাথ ঘটা করে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন,
'এবারের নববর্ষ সংখ্যায় থাকছে অমিয় সমাদ্দারের বড় গল্প!'
সঙ্গে সঙ্গে 3k লাইক। শেয়ার শ'র কাছাকাছি। কমেন্টের বন্যা। এতদিন
পর লেখক ফিরছেন। তারওপর স্পেশাল ইস্যু। দপ্তরের ফোন, মোবাইলে ফোনের পর ফোন।
কেমন গল্প? পত্রিকা কবে প্রকাশিত হবে? নানা প্রশ্ন। বিজ্ঞাপনটা
যে এতটা ফেটে যাবে ভাবতেই পারেননি সম্পাদক।
খটকাটা অন্য জায়গায়।
অনেক বেশি অবাক হয়েছিলেন গল্পটা পেয়ে।
যে মানুষটা সুললিত ভাষায় গল্পের খোশ মেজাজ ফিরিয়ে আনেন।
বাচ্চারা দু'গালে হাত দিয়ে গল্প শোনে তারা এ গল্প পড়বে?
এ কেমনধারা গল্প?
ভয়, চিৎকার, রক্ত। গা
ঘিনঘিনে উদ্ভট এক রহস্যকাহিনী।
অবাক হয়েছিলেন। পড়েছিলেন আতান্তরে। এদিকে অমিয়বাবুর
গল্পের অপেক্ষা করে করে শেষমেষ পত্রিকা প্রেসে যাচ্ছিল সেদিনই। গল্প ফেরতের অবকাশও ছিল না।
কিশোররা কি এমন গল্প পড়বে?
সত্যি কথা কী সম্পাদকীয় দপ্তরের বাকিদের সঙ্গে বেশ মন কষাকষি করে তবে হরিহর
নাথ গল্পটা ছাপেন। তবে
মনে মনে এও ঠিক করেন,
'পাঠক না নিলে অমিয়বাবুকে সরাসরি জানাবেন।'
কিন্তু লেখকের কপাল বেড়ে। গল্প
চলল। বলা ভাল ছুটল।
ফেসবুকে একের পর এক রিভিউ। হাসিখুশির বাকি পাঁচটা গল্পকে বলে বলে পাঁচ গোল
দিয়েছিল অমিয়বাবুর 'বাদুড়ের চোখ'!
সত্যি পাঠক যে কি চায় আর কি চায় না স্বয়ং ব্রম্ভাও জানে না।
সেই থেকে শুরু। 'হাসিখুশি' থেকে 'প্রথম নৌকা', 'সবুজ মন', 'ক্লাসরুম' বিভিন্ন
পত্রিকা অমিয়বাবুর গল্পের জন্য হাপিত্যেস করতে থাকে।
স্বাভাবিকভাবে জনপ্রিয়তায় সাংঘাতিক খুশি হন হরিহর নাথ। রক্তারক্তির গল্পের ক্রেজ দেখে পত্রিকার নাম
পাল্টে রাখেন 'রাত বারোটা'। একদিন
মিষ্টি হাতে সোজা চলে আসেন লেখকের বাড়িতে। বলেন,
'আপনি তো ফাটিয়ে দিয়েছেন মশাই। কিন্তু
এমন একটা লেখা আপনার হাত থেকে। আমি তো জাস্ট ভাবতে পারিনি।'
'আমিও কী ভাবতে পেরেছিলাম?' নামানো মাথাটা দুলিয়ে দুলিয়ে বলেছিলেন অমিয়বাবু।
পরিবর্তনটা যে শুধু লেখাতে নয়, অমিয়বাবুর মনেও হয়েছিল বুঝেছিলেন
হরিহর নাথ। ঘরের চূড়ান্ত অগোছালো ভাব। দেওয়ালে নানা আকৃতির জলের নকশা, স্যাঁতস্যাঁতে জলো ভাব।
থেকে থেকে হাওয়ার মত নাকে ঝাপটা দেওয়া পচা গন্ধ। মশা মাছির তুমুল ভিড় দেখে যেকোনো সাধারণ মানুষই
বুঝবে অমিয়বাবু ভাল নেই। অমিয়বাবু যে পুরোনো বাড়িতে
থাকছেন সবাই জানতেন। কিন্তু এমনতরো অপরিচ্ছন্ন আগে
ছিল না। মধ্যবিত্ত হলেও ঘরদোরে যে ছাপোষা শ্রী ছিল তা যেন
কোন ম্যাজিক শোয়ের মত একচুটকিতে গায়েব। ভদ্দরলোকের
জীবনটায় হাসি হারিয়ে দমকা একটা কালো ঢুকে পড়েছে হুড়মুড়িয়ে। সেদিন নিজের আনা মিষ্টির সবকটাই বড় বিস্বাদ
ঠেকেছিল হরিহরবাবুর। বেশি
কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিলেন বাড়িতে। মনে
মনে ঠিক করেছিলেন, 'অমিয়বাবু নিজে থেকে না দিলে আর লেখা নিয়ে তেমন জোর করা ঠিক হবে না।'
এটা তো ঠিকই। হরিহরবাবুর নিজেরই কেমন কেমন
লাগে যখন গিন্নি ৫দিনের নাম করে ১৫দিন বাপের বাড়ি কাটিয়ে আসেন।
তবুও তো তাঁর দুই গাধা ছেলে বাড়ি থাকে। হায়!
অমিয়বাবু তো সে সুখ থেকেও বঞ্চিত।
হঠাৎই একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছিল।
সবেমাত্র বিকেলের চা নিয়ে বারান্দায় বসেছিলেন হরিহর নাথ।
'হ্যালো!'
'কে?'
'আমি বিনয়!'
'বিনয়?'
'আরে চিকুকে ভুলে গেলে জামাইবাবু? কণাদির মামাতো ভাই।'
'এতদিন পর? মিডিয়ার ব্যস্ত মানুষ। বাপের
শ্রাদ্ধ হলেও তো তোমাদের দেখা পাওয়া যায় না।'
'কী যে বলো জামাইবাবু। মানুষের জন্যই তো আমাদের কাজ।
আমার ছেলে সৌরভ সেভেনে পড়ে। 'হাসিখুশি' পড়ে নিয়মিত।'
'তা বেশ। শুনে ভালোলাগলো। এতদিন কোনও খবর নেই হটাৎ কী মনে করে শালা?'
'এ মা ছি
ছি গাল দিয়ো না
জামাইবাবু। বিষয়টা তোমার পত্রিকা নিয়েই। কাল রবিবার। সপরিবারে জ্বালাতে আসছি। কেমন?'
ফোনটা কেটে যায় হরিহরবাবুর ছোট্ট 'হ্যাঁ'র পর।
ডাক নাম চিকু। ভাল
নাম বিনয় পোদ্দার। হরিহরবাবুর সম্পর্কে শালা।
'খবর বাংলা'র নিউজ এডিটর।
এসব লোক তাঁর মত শখে সাহিত্য করা লোকজনের কাছে খুব একটা আসেন না।
তবে? উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছিলেন ফোনটা আসার পর থেকেই। ব্যাপারটা
ঠিক এই খাতে বইবে আশা করেননি।
রবিবার বিনয় এসেছিল সপরিবারেই।
বলেছিল,
'জামাইবাবু আপনি তো সাংঘাতিক কান্ড করে বসেছেন!'
'কী ব্যপার বলো তো চিকু? আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।
পত্রিকা নিয়ে কী এমন কথা থাকতে পারে যে...!'
'বাদুড়ের চোখ। ওটা তো ঠিক গপ্পো নয়!'
'এ্যা! কী হেঁয়ালি হচ্ছে খুলে বলো!'
'বলছি। তার আগে এটা পড়ুন।'
চিকু ব্যাগ থেকে একটা খবরের কাগজের ভেতরের পাতা এগিয়ে ধরে তাঁর জামাইবাবুর
দিকে।
ভুরু দুটো কাছাকাছি চলে এসেছিল হরিহর নাথের।
চশমাটাকে নাকের সামনে থেকে ঠেলে পেছনের দিকে তুলে পড়তে শুরু করেছিলেন ছাপার
অক্ষরগুলো।
যত সময় যাচ্ছিল কী এক চরম উদ্বিগ্নতা ফুটে উঠছিল
হরিহর নাথের সারা মুখময়। কপালে
জমতে শুরু করেছিল বিন্দু বিন্দু ঘাম। এও
কী সম্ভব?
একেবারে হুবহু। শুরু থেকে শেষ। গোটাটা। জায়গা এমনকি চরিত্রের নাম সব সওওওবব?
খবরটা এইরকম,
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার পাঁচবেড়ে এলাকার যদু কলোনির
এক উঁচু ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে ঝাঁপ দেয় রুমকি সাহা নামে এক কিশোরী।
বয়স ১৭। সারদা বালিকা বিদ্যালয়ের একাদশ
শ্রেণীর ছাত্রী। শুক্রবার ভোর ৫টা নাগাদ
ফ্ল্যাটের পেছনের দিকে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। অনুমান
ভোররাতের দিকে কোনও এক সময় ছাদ থেকে ঝাঁপ দেয় মেয়েটি। প্রতিবেশী এবং পারিবারিক সূত্রে যেটুকু জানা যায়
রুমকি পড়াশুনায় যথেষ্ট ভাল ছাত্রী ছিল। পরিবারের সঙ্গে বিশেষ কোনও মনোমালিন্য ছিল না। কিন্তু
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা মৃতদেহ অদ্ভুতভাবে বিকৃত। পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট এলে সবটা পরিষ্কারভাবে
জানা যাবে। তদন্ত চলছে।'
কাগজটা মুড়ে টেবিলে রেখে দিয়েছিলেন হরিহরবাবু।
বলেন, 'এটা একটা কোইনসিডেন্ট।'
'হুম আমিও তাই ভেবেছিলাম জামাইবাবু। আমার
ছেলে পিকলু এসে যখন গল্পটা শোনায় ঠিক ধরতে পারিনি। কিন্তু
যখন বইটা নিয়ে পড়ি। এতটা
মিল?'
অস্বস্তি লাগছিল হরিহর বাবুর। এই
মিডিয়ার লোক ছুতো পেলে হয়কে নয়, নয়কে হয় করে কাগজের টিআরপি বাড়ানোর জন্য। তাঁর
সামান্য সরকারি চাকরি। শখে এসব সাহিত্যে ঘোরাঘুরি।
এরপর যদি শালাবাবু পেছনে লাগে। যা
এ কয়দিন লোকে কিনে পড়ছে তাও ভোগে যাবে। বলেন,
'দেখো ভাই অনেক লেখকই কাগজের খবর দেখে গল্প লেখেন এতে দোষের কী আছে?'
'সেটা আমি জানি। কিন্তু
একটা জিনিস কী খেয়াল করেছেন? আপনার বইটা প্রকাশ পেয়েছে ১৫ই এপ্রিল। আর খবরটা ওই তো হাতেই আছে দেখুন দেখুন ১৭ই এপ্রিল।'
'কিন্তু তাতে কী?'
'তাতে অনেক কিছুই। আমি খবরটা কভার করতে গেছিলাম। কারণ একটাই। কেসটায়
একটা নতুন গন্ধ পেয়েছিলাম। এক নম্বর মেয়েটার বডি। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত। চোখে দেখা যায় না। অন্ত্র
সমেত সব বেরিয়ে ঘাস গাছে লেগে। দ্বিতীয়
মেয়েটার একটা ডায়েরি পাওয়া গেছে। যেটা
কাগজে লেখা নেই। ওটায়
ও নাকি সারাক্ষণ একটা কিছু দেখত। ঘুমাতে
পারত না। খেতে পারত না। কী
দেখত সেটা ক্লিয়ার নয় তবে অনেকটা নিশাচরের জ্বলন্ত চোখের মত।
মানসিক দিক থেকে ভেঙে পড়ছিল কি কোনও কারণে? ঠিক
কী? এই এই ব্যাপারটাই আমাকে ভাবিয়েছে। ভাবতে বাধ্য করেছে। পুরো যে ওই গল্পটা। প্লিজ জামাইবাবু আমি একবার লেখকের সঙ্গে দেখা করতে চাই।'
হরিহরবাবু কেঁপে উঠেছিলেন। পুলিশে
ছুঁলে আঠারো ঘা। আর মিডিয়ায় ছুঁলে! কত ঘা কে জানে?
কী বিপদ! কী বিপদ!
ম্যানেজ করে বলেন,
'শোনো তাহলে খুলেই বলি। লেখকদের মাথার হদিশ কে কখন দিতে
পেরেছে? তেমন সিরিয়াস কিছু নয়। ভদ্রলোক সদ্য স্ত্রী হারিয়েছেন। একটু ঘেঁটে আছেন। তাই
এসব! এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে খামোকা...। তুমি চিন্তা করো না। আচ্ছা আমি নাহয় একবার ওনাকে জিজ্ঞেস
করব। গোবেচারা মানুষ আমার কাছে যতটা
সহজ হবেন তোমার কাছে তো নাও হতে পারেন।'
আশা করাই যায়। সেদিন হরিহরবাবুর কথা তেমন মনে
ধরেনি বিনয়ের।
দেড় ঘন্টা মত আড্ডা, এদিক সেদিক কথা বলে
বাড়ি ফেরার পথে বলেছিল,
'জামাইবাবু বেশ বেড়ে সম্পাদক হয়েছেন।'
তিনি উত্তরে কিছু বলেননি। মনের মধ্যে একটা আলগা পেরেক
গেঁথে গেছিল। খচখচ করছিল।
কি করে এতটা মিল?
তবে ঠিক করেছিলেন ব্যাপারটা কোনোমতেই
কানাকানি হতে দেবেন না। অমিয়বাবুকেও এখনই কিছু বলবেন
না। এমন তো নয় যে একটা গল্প মিলেছে বলে সবকটা গল্পই
মিলবে? আরেকটু দেখাই যাক না। তারপর
না হয়...!
হাজার হোক বছরখানেক পর পত্রিকার সার্কুলেশন দ্বিগুণ তো
হয়েছে।
***********
এরকম করেই কাটছিল। হটাৎ এর মধ্যেই আরেকটা ঘটনা
সামনে আসে।
দিনটা ছিল নববর্ষের এক দু'মাস পর একটা শনিবার।
এইসময়টায় হরিহর বাবুর দপ্তরে জমায়েত হয় অনেকেই।
ওই আসছে পুজোসংখ্যার গতিপ্রকৃতি কেমনধারা সেসব নিয়ে একটু আলোচনা।
দপ্তর বলতে হরিহর নাথ বাড়ির একতলাটা গুছিয়ে নিয়েছেন নিজের মত করে।
বেশ কয়েকটা নতুন ধারার পত্রিকার লেখক সম্পাদকও আসেন।
একথা ওকথার পর 'সবুজ মনে'র
সম্পাদক নিখিল দেব বলেন,
'দাদা অমিয়বাবুর মাথায় কি ছিটটিট হয়েছে নাকি?'
'কেন বলোতো?'
'আর বলবেন না; সেদিন আমার মোবাইলে ফোন করেছেন। আমি
তো প্রথম চোটে একটু অবাকই হয়েছিলাম। আর
কী বলব? ওনার স্ত্রী বেঁচে থাকাকালীন একটা সাম্মানিক দেওয়া হয়নি।
ভাবলাম আগের
ডিউটা চাইতে ফোন করেছেন। কোনোরকমে
কেটে বেরিয়ে ফোন রেখে দেব ভাবছি। ওমা দেখি ওসব কোনও কথাই নয়।
সিধে আমাকে বলেন, 'আমি একটা গল্প লিখেছি। নেবেন?'
'সে কী? তোমাকেও?'
'হ্যাঁ আমাকেও।'
'তা তুমি কী করলে?'
'বললাম পাঠিয়ে দেন। অমিয়দা
বললেন ইন্টারনেট চলছে না। এখন ডাকে যেতেও পারবেন না। কী একটা অসুবিধা আছে। আমি
যদি কাউকে পাঠিয়ে নিয়ে যেতে পারি। আজব! সত্যি কথা বলতে আমার খুব
একটা ইচ্ছে যে হয়েছিল এমনটা নয়। দেখছ
তো যা বৃষ্টি চলছে তার মধ্যে বাড়ি অফিস সামলে কে আর ধারধারা গোবিন্দপুরে গল্প নিতে
যায়?
চিন্তা করলুম। শেষমেষ ভাবলুম তুমি আমাদের বড়দা
যখন সাহস করে 'বাদুড়ের চোখ' ছেপে রাতারাতি ফেম পেলে। আমার
এই কচি বুকে আর সাহস দেখাই কেন?'
'শেষমেষ গেলে?'
'হ্যাঁ গেলুম। বাড়ি
চিনতে তো অসুবিধা হয়নি। আগেও গেছিলুম। কিন্তু বাড়ির ওই হাল হয়েছে জানলে আর ওই চত্বর
মারাতাম না। বাড়ি ঢুকতে যাব দেখি একখান মরা কাক ঘেঁটে থেঁতলে
পড়ে আছে। কী অপয়া কান্ড! ভাবলাম আজ আর গপ্পো পাবার আশা নেই। ভেতরে ঢুকে দেখলাম অমিয়দাও যেন কেমন একটা হয়ে
গেছেন। কিন্তু জানো গপ্পো আমি পেলুম।
এখনো সেইরকম একতাড়া কাগজ আমার হাতে গুঁজে দিলেন। বিশেষ কিছু কথা আর হয়নি। চলে
এসেছিলুম।'
'গল্পটা ছেপেছ?'
'হ্যাঁ ছেপেছি। আর
ছাপতেই তো যত বিপদ। অমিয়দা গল্পটা লিখেছে বটে। কিন্তু লিখেছে না বলে ওটা টুকেছে বলাই ভাল।'
'মানে?'
'মানে টিভির একটা খবর এ টু জেড টুকে দিয়েছে ভদ্দরলোক।'
'খুলে বলোতো?' হরিহরবাবুকে উদ্বিগ্ন দেখায়।
'আর বলবেন না। সবুজ
মনে অমিয়দার গল্পটা বেরোনোর পর আমার স্ত্রীই ডেকে নিয়ে দেখায় খবরটা। টিভিতে দেখাচ্ছিল। আপনি দেখেন নি? ওই
যে ডায়মন্ড হারবারে রোডে এক মহিলা একা থাকতেন। কল সেন্টারে না কোথায় কাজ করতেন।
রাত করে বাড়ি ফিরছিলেন। দেহটা পাওয়া গেছে মহিলার
ফ্ল্যাটের থেকে কিছুটা দূরেই। আশ্চর্যের ব্যাপার হল মহিলাটার
হাতের দশ-দশটা আঙুলই কাটা ছিল। আর
পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে সব সমেত চাপ চাপ রক্ত লেগে ছিল রাস্তায়। পুলিশ বলছে একা মেয়েমানুষ থাকত।
কোনও পুরোনো প্রেমিক হয়ত রাগে এসব।'
'আসলে তোমার বৌদির শরীরটা ইদানিং ভাল যাচ্ছে না। তাই
আর খবর টবর সেভাবে দেখা হয়ে ওঠে না। তোমার
পত্রিকাটা একবার দেবে? পড়তাম তাহলে। সঙ্গে আছে?'
'হ্যাঁ হ্যাঁ নিন না। এইতো।'
হাত বাড়িয়ে পত্রিকাটা নিয়েছিলেন হরিহরবাবু। চিকুর কথায় যে আতঙ্কের রেশ ধামাচাপা দিয়েছিলেন।
সেটা আবারও ওঠানামা করছিল পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে। কানের পাশ দিয়ে গড়ানো ঘামটা কোনোরকমে মুছে
কিছুক্ষণের মধ্যে অফিস বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বারবার
মন চলে যাচ্ছিল গল্পটার দিকে। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরেই বসে গেছিলেন। গল্পটা ঠিক এইরকম,
'ওরা কে বা কারা আমি ঠিক জানি না। তবে
ওরা যে সবসময় আমাকে লক্ষ রাখছে। আমার
পিছু নিয়েছে এটা সত্যি। একদিন পুলিশেও ডায়েরি করতে
গেছিলাম। কিন্তু তেমন কিছু ঠস সবুদ দিতে
না পারায় পুলিশ শুধু আমার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার নিয়েই রেখে দিয়েছে। আমার কাউকে সন্দেহ হয় না। সবাই
তো আমাকে ভালবাসে। কে
মারতে চাইবে আমায়?
শিউলি সোম আমি। ছোট থেকেই পিসিরবাড়ি মানুষ।
বাবা মাকে চোখে দেখিনি। একা থাকার অভ্যাসটা তো আমার
বরাবরই। কিন্তু এখন এত ভয় করে কেন?
যতটা পারছি পা চালিয়ে হাঁটছি। আমার মনে হচ্ছে ওরা ধারেকাছেই কোথাও আছে।
তবে একয়দিনে বুঝেছি ওরা আলোকে ভয় পায়। তাই
আমি আলো ঘেঁষে হাঁটছি। ল্যাম্পপোস্ট
বা আধশাটার টানা দোকানগুলোর গায়ে গায়ে পা রাখছি। অফিসের ক্যাবটা আজ এতটা দূরে নামিয়ে দিল। বাড়ি পৌঁছতে আরও পাঁচ মিনিট।
একি? এত ঠান্ডা হাওয়া বইছে কেন? বৃষ্টি নামবে কি? ছাতা তো নেই। আমার খুব ভয় করছে।
আর তারপরেই কান ফাটানো শব্দ করে চারদিক আলো করে
বিদ্যুৎ চমকায়। পেছন ফিরে কী যেন একটা দেখে
দৌড়তে শুরু করে মেয়েটা। কাঁদতে থাকে।
কান্না আর বৃষ্টি ছাপিয়ে আচমকা
আরেকটা আওয়াজ শুরু হয়। একটা গজড়ানোর শব্দ। যেন যেন কারুর খুব রাগ হয়েছে। আরও জোরে বৃষ্টি নামে। তার
সঙ্গে লাগাতার করকর শব্দে মেঘ ঘষাঘষি বাজ পড়তে শুরু করে।
নিভে যায় শহরের সব ক'টা আলো।
আর তারপরে ভয়ানক এক আর্ত চিৎকার।
সকালে উঠে সবাই শিউলিকে খুঁজে পেয়েছিল রাস্তায়।
ও তো ছিলই না। ছিল না ওর যে ক'টা
আঙুল আলো খুঁজেছিল সবক'টাই।'
নিম্নচাপের বৃষ্টিটা গোটা শহরটাকে ভিজিয়ে দিয়েছে। কখন
যে এতটা রাত হয়ে গেছে বুঝতে পারেননি হরিহর বাবু। দূরে কোথায় একটা কুকুর গলা ছেড়ে ডাকছে। ওনার নিজের গলাটা শুকিয়ে গেছে। ঢকঢক করে জল খান। এসব কি লিখেছেন অমিয়বাবু?
প্রথমে চিকু। তারপর সুনীল। জানতেই হবে। অন্ততঃ
একটা প্রশ্ন তো করতেই হবে।
***************
'এখন কেমন আছ?'
'ভাল গো! আগের থেকে অনেকটা ভাল।
কাল খুব বৃষ্টি হয়েছে না গো? বাজ পড়ছিল।
জানো বাজ পড়লেই আমার খুব ভয় করে।'
'পলা এত ডিপ্রেসড হচ্ছ কেন? আমি তো তোমার সঙ্গেই আছি নাকি।
পুজো আসে আসে। এখন এত বৃষ্টি আগে দেখিনি।
মোড়ের দেবদারু গাছটা অর্ধেক পুড়ে গেছে। এই পলা লক্ষ্মীটি আমি তাহলে একটু নীচে যাই? অফিসে কিছু লেখা এসে জড়ো
হয়েছে। পত্রিকার কাজটা অনেকটাই বাকি। আমি বরং সুবিকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।'
'আমাকে একটু টিভিটা চালিয়ে দেবে?'
'আর বলো না। ক'দিন থেকেই টিভির
কানেকশনটা বন্ধ। ছেলেগুলোকে
ডাকছি। আজ আসব। কাল আসব বলে কাটাচ্ছে। দাঁড়াও নীচ থেকে পেপারটা দিয়ে যাচ্ছি। দেখো কিছুক্ষণ।'
বেডরুমের দরজা ভেজিয়ে একতলায় নেমে আসেন হরিহরবাবু। যা গেল এ ক'দিন বলার মত নয়।
সেদিন অমিয়বাবুর বাড়ি থেকে ফেরার পর পলা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সারা ঘরময় বমি করে ভাসিয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্স ডাক্তার নার্সিংহোম কোনও কিছুই বাকি
রাখেন নি। ফুড পয়জনিংটা একসপ্তাহ আগেই হয়েছিল।
ওষুধ পড়া সত্ত্বেও কিছুতেই করছিল না। আজ
সকাল থেকে একটু বেটার। সবে
বসার ঘরের দরজাটা খুলেছেন হরিহর নাথ,
'বাবা ও বাবা চিকুমামা ফোন করেছে। খুব দরকার। তুমি ফোনটা ধরো।'
'চিকু? এখন? আবার কী হল?'
'হ্যালো!'
'শুনেছেন জামাইবাবু? আপনি বাড়িতে না ওখানে?'
'মানে?'
'সেকি আপনি জানেন না? লেখক অমিয়বাবু আর নেই!'
'কী বলছ কি তুমি? আমি পরশুই গেছিলাম ওনার বাড়ি। উনি কথা বললেন।'
'ঠিকই বলছি! বাড়ির মধ্যে থেকে পচা গন্ধ আসছিল। বাড়ির ঠিকানাটা জানার পর আমার সন্দেহ হয়।
ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে আমাদের জুনিয়র জার্নালিস্ট গেছে।
ফোনটা ছাড়ছি। ইউটিউব
চালান। লাইভ দেখাচ্ছে চ্যানেলে।'
কাঁপা হাতে ফোনের ওয়াই ফাই অন করেন হরিহর নাথ।
'খবর বাংলা। কত লোক। কত
লোক গিজগিজ করছে। হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ ঐতো
ঐতো দেখতে পাচ্ছে অমিয়বাবুর বাড়ি। চারদিকে
গাছপালা আগাছার দলা গায়ে মেখে মৃত কবরের মত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আর ঐটা ঐটা কী দেখাচ্ছে রিপোর্টার ছেলেটা। ডানপাশের ভলুমটা আরেকটু বাড়ায় হরিহর নাথ!
'আপনারা দেখতে পাচ্ছেন আমরা চলে এসেছি সাহিত্যিক অমিয় সমাদ্দারের বাড়ি। ইনি শিবু রোজ এখান দিয়েই সাইকেলে খবরের কাগজ বিলি
করে বেড়ান। অমিয়বাবু কাগজ নিতেন না।
কিন্তু কালকের বৃষ্টিতে এতটাই গাছপালা উপড়ে পড়েছে বাড়িটাকে ঘিরে।
রাস্তা পেরোনোর উপায় ছিল না।
সাইকেল থেকে নামতেই গন্ধটা পান। গন্ধটা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে
খবর দেন। ঠিক কি হয়েছিল আমরা শিবুবাবুর মুখ থেকেই শুনে নেব।
'আমি তো রোজই যাই। জানতাম
লোকটা খ্যাপাটে। আগে একটা বউ ছিল। এখন দেখি না। মাঝে
মাঝে বাড়ির চারধারে ঘুরতে দেখতুম। আজ
একেবারে সব দিক তছনছ। এত
বিচ্ছিরি গন্ধ। সবাই
বলছে কালকের আগে মারা গেছে লোকটা। ঘরের মধ্যেই ছিল বডিটা।'
'আচ্ছা উনি কোনোদিন আপনার সঙ্গে কথা বলতেন না?' কথাগুলো শুনতে শুনতে ধপ করে
সোফায় বসে পড়েছিলেন হরিহর বাবু।
বড্ড ভারী হয়ে আসছিল বুকের মধ্যেটা।
আরও কী একটা দেখাচ্ছে খবরে।
'আমরা চলে এসেছি বাড়িটার পেছনে। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন বিশাল একটা গর্ত।
সুজিত ক্যামেরাটা আরেকবার ধরো; গর্তটা ঠিক যেন অনেকটা হাতের মত ছড়িয়ে বাড়িটাকে ঘিরে
রয়েছে। এখানে এই গর্তটা কিভাবে হল? তাহলে কি কলকাতা শহরের
কাল যে বাজ পড়েছে তাতেই কোনোভাবে এই গর্তের সৃষ্টি?'
রিপোর্টার ছেলেটা আরও কী কী সব বলছিল; কথাগুলো কেটে কেটে যাচ্ছিল।
কয়েকটা শব্দ কানে আসছিল শুধু।
এলাকার মানুষ সন্দেহ করত। প্রায়ই বাড়ির চারপাশে মৃত পশু পাখি থেঁতলে... তাহলে কী উনি কোনও
ভয়ঙ্কর জন্তু পুষেছিলেন? একটা শব্দ আসত প্রায়ই...! ওনার স্ত্রী কিভাবে মারা
গেছিলেন? নাকি লেখক মানসিক দিক থেকে কোনোভাবে? সবটাই তদন্ত সাপেক্ষ।
বুকের মধ্যেটা জট পাকিয়ে যাচ্ছিল।
কে যেন বেল বাজাচ্ছে। টলতে টলতে গিয়ে ড্রয়িংরুমের
বাইরে পা রাখেন।
'পোস্টম্যান! হরিহর নাথ বাবু? একটা স্পীড পোস্ট আছে।
কালকেই আসতাম। এত
ঝড় জল শুরু হল সকাল থেকে। পাঠিয়েছেন অমিয় সমাদ্দার।'
আঁতকে ওঠেন হরিহর বাবু। সারা
শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। মুহূর্তে সব শক্তি হারিয়ে যায়।
কোনোমতে শক্তি জড়ো করে খানিকটা বাধ্য হয়েই বাদামি খামটা ধরেন।
হঠাৎই যেন কেউ সব রক্ত শুষে নিয়ে সম্পূর্ণ একা নির্জন বালিয়াড়িতে দাঁড়
করিয়ে রেখে গেছে হরিহর নাথকে।
খামটার ওপর বড় বড় হরফে লেখা
(পুজোসংখ্যার গল্প)
পরশু দিন যে মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন সে
কী করে?
তাহলে কি অমিয়বাবু জানতেন?
হরিহরবাবু নিজে নয়। যন্ত্রচালিতের
মত তার হাত খামের মুখ ছিঁড়ে বের করে আনে একতাড়া সাদা কাগজ;
'হ্যাঁ আমার ডাক এসেছে। ভুল বললাম।
ডাক এসেছে। ডাক এসেছে আমাদের দুজনের কাছেই।
আমি একা হলেই ডাকটা হেঁটে চলে বেড়ায়। আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। পুরো শরীর দিয়ে একটা মেয়ে মানুষের রূপ নেয়। আমাকে ছুঁতে চায়। আমার
সঙ্গে কথা বলতে চায়। ওকে তখন অনেকটা সৌমীর মত হয়ে
যায়। অনেকটা কেন ওতো সৌমীই। ও
আমার সৌমীকে নিয়েছে। আমার
প্রিয় সব কিছুকে নিচ্ছে। আমার
ছোট্ট ভুলুকেও নিয়েছে। নিয়েছে
টিয়াটাকেও। আমি ওকে সবার থেকে লুকিয়ে রাখি। সবার চোখের আড়ালে। ও
থাকতে চায় না। ওর খিদে কমছে না।
বেড়েই যাচ্ছে। বেড়েই
যাচ্ছে। হ্যাঁ ও খুব আলো খেতে ভালোবাসে। ও বলেছে ও সবাইকে নেবে। ওর
কাছে নেবে। এই পৃথিবীতে যা কিছু আলো যা কিছু ভালো তাই ও গিলে
খেতে চায়। যত খায় তত ওর গলা বুজে আসে। ঘরঘর ঘরঘর শব্দটা অনেকটা যেন হাজার তুফানের মত
শোনায়। দু'হাতে কান চেপে ধরি। ওই শব্দ সরে না। নড়ে না। যত
বেশি শব্দ তত বেশি আধখাওয়া নাড়িভূরি যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বেরিয়ে আসে ওর মুখ
দিয়ে। যা কিছু ও খায়।
সব বেরিয়ে আসে। আমি
কাঁদি। সৌমিও কাঁদে। সৌমী
শব্দের গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। পারে
না। কাঁদতে কাঁদতে বলে অমিয় পালাও পালাও পালিয়ে যাও। আমি পালাতে পারি না। যদি
সত্যি একদিন সৌমী ফিরে আসে। আমার
চুপ পৃথিবীর কোণায় দাঁড়িয়ে বলে অমিয় তুমি আবার আগের মত সব ভাল গল্প লেখো।
আলো গল্প লেখো। এমন গল্প তো তুমি লেখো না আর? এ কোন অমিয়। এ অমিয়কে আমি চিনি না। আমি
বলি আমি গল্প লিখি না সৌমী। আমি তো সত্যি লিখি।
যেদিন রাতে পাঁচতলা থেকে রুমকি উড়ে উড়ে পড়েছিল আর শব্দ ওর গলা ছিঁড়ে আলো
খেয়েছিল। সেদিন আমি সব দেখেছি। দেখেছি ওই যে মেয়েটা হেঁটে হেঁটে ফিরছিল ওর সব ক'টা আঙুল গিলে নিল
রাক্ষুসীটা। কিভাবে তোমাকে মেখে তোমার নরম চুল মেখে আস্ত একটা
জ্বলজ্বলে পিশাচিনি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজ।
ও চলে যাবে। খুব
তাড়াতাড়ি চলে যাবে। তবে তুমি যে ওর মধ্যেই।
আমি তোমাকে ছাড়া থাকব কি করে সৌমী! আমিও যাব।
সৌমী আমরা একটা নতুন সকাল দেখব।
ওর দেশের সব কালো মিলিয়ে একটা আলো সকাল তৈরি করব আমরা। আর তারপর... একে একে ফিরিয়ে দেব সব
আলো প্রাণ।
কিন্তু ওই যে ওই যে ও যে আমাকে নিতে আসছে। আহ
'আহ... গল্পটা শেষ হওয়ার আগেই যন্ত্রণায় একটা কাতর কন্ঠস্বর শুনতে পান হরিহরবাবু।
পলা কি হল ওর?
পলার কী হল?
প্রায় এক নিঃশ্বাসে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শুনতে পান একটা শব্দ
ঘর ঘর ঘরঘর ঘর ঘর...!
(সমাপ্ত)
গল্পটি শুনতে চাইলে নিচের link এ click করুন
Comments
Post a Comment