"মৃত্যুর ডাক"



মৃত্যুর ডাক

'তাই বলে হরিদা একেবারে ভেজ থেকে নন-ভেজ?'
'হ্যাঁ আসলে নববর্ষের গল্পটা এমনভাবে চলল আর তার সঙ্গে পাবলিকের ডিম্যান্ড সহকারী সম্পাদক বলল দাদা নামটা চেঞ্জ করুন চলবে ভাল!'
'ভাবাচ্ছে মশাইবেশ ভাবাচ্ছে 'হাসিখুশি' নাম পাল্টে যখন 'রাত বারোটা' নাম হয় তখন আমার মত পাঁচমেশালি লিটিল ম্যাগের কী অবস্থা বুঝতেই পারছেনঅমিয়বাবুর মত ক'জন লেখক আর আমাদের পত্রিকায় লিখবেন? সাম্মানিক তো তেমন করে দিতে পারি নাঅনেক কষ্টে এনাকে পেয়েছি'
'কিন্তু কমলেশ তুমি আজ এখানে...?' কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন গলায় বাধছিল সম্পাদক হরিহর নাথেরকমলেশ সঙ্গে থাকলে তো ভদ্রলোকের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনাটা করা যাবে না! মহা মুশকিল হল? অনেক চেষ্টা চরিত্র করে স্ত্রীকে কাজের বউয়ের কাছে রেখে এসেছেনছেলেরা যে যার কাজে ব্যস্ত ঠিক কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন নাঅমিয়বাবু কী জেনেশুনে করছেন? মন থেকে তো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে নাআর সত্যি সত্যি যদি নাই হয় তাহলে তো মানুষটাকে সতর্ক করে দেওয়াও তো দরকার কেমন যেন তালগোল পেকে যাচ্ছিল মাথার মধ্যে
'কী হরিদা কি ভাবছেন? ও হরিদা কি হল শরীর খারাপ করছে নাকি আপনার?'
'এ্যা কী কী ডাকছ ডাকছ আমাকে?'
'ডাকছিই তো'
'না আসলে তোমার বৌদির শরীরটাও ভাল নেই এদিকে অমিয়বাবু সেই যে ঘরে ঢুকেছেনএত দেরিআর যে বসতে পারছি না'
'ঠিকই তো অমিয়দার বাড়ি আসা যেন শাস্তি একরকম যা নোংরা মেলোচ্ছ জায়গা বাড়ি গিয়ে স্নান না করা অবধি শান্তি নেই একটা পুজোর লেখার জন্য কতবার যে ঘুর ঘুর করছি ভাবতে পারবেন নাপ্রথমে আপনাদের পত্রিকা তারপর কচি পাতা, সবুজ মনে পরপর গল্পদুটো যেভাবে বাজার কাঁপাল তাতে এ পুজোয় অন্ততঃ দাদার একটা অণু টনু পেলেও ধন্য পাড়ার ভুলুদা বলেছে কমলেশ অমিয়দার একটা গপ্পো আনো আমিও তোমাদের পত্রিকায় আমার ক্যাটারারের বিজ্ঞাপন ছাড়ব বোঝেন-ই তো আমাদের অবস্থাভাবছি এই হয়ত দিলেনসামনের মাসে পাবকিন্তু যে কে সেই...! মুখ ফুটে নাও বলেন না'
কমলেশবাবু বকেই যাচ্ছিলেনতাহলে ব্যাপারটা জানে না ছেলেটা? নিশ্চয়ই জানে নাকিন্তু অমিয় সমাদ্দারকে কথা ক'টা জিজ্ঞেস যে খুবই দরকার খুব'
'কিন্তু কেউ মানুক আর ছাই নাই মানুক ভদ্দরলোকের এলেম আছেনাহলে পাঠকের চাহিদার সঙ্গে নিজেকে এমন করে কেউ পাল্টে ফেলতে পারে? উঁহু হু হু আর যে বসা যাচ্ছে না হরিদা গন্ধটা পেয়েছেন? সেই এসে বসা থেকে পাচ্ছিবড্ড বেয়ারাভাবে বেড়ে চলেছে আগেও দু'এক বার এসে পেয়েছি কিন্তু আজ যেন একটু বেশিই...আধঘন্টা হতে চললঅমিয়বাবু যে কোন চুলোয় গেলেনও অমিয়দা অমিয়দা? এদিকে ওনাকে ফোনেও পাওয়া যায় নামেল রিসিভ করা তো কবে ছেড়ে দিয়েছেন! পুজো এগিয়ে আসছে কী যে করি?'
'লোকটার গিন্নি চলে যাওয়ার পর থেকে বাড়িখানাকে এক্কেবারে নরক বানিয়ে রেখেছে আগে বৌদি নিজে হাতে করে দোপাটি, গাঁদা, গোলাপের চারা লাগিয়েছিল সামনের খোলা বাগানটায় আর এখন পোড়ো বাড়ি পুরোনাহ নাহ...! সত্যি কমলেশ গন্ধটা তো...! অন্নপ্রাশনের ভাত বেরিয়ে এল'
নাকে রুমাল চেপে উঠে দাঁড়ান হরিহর নাথ সঙ্গে কমলেশ রায়ওদুজনের কথাবার্তা শুনে আন্দাজ করা যাচ্ছে যে দুজনেই পত্রিকার সম্পাদক কমলেশ রায় পুজোসংখ্যার গল্প চাইতে এলেও আরেকজন ঠিক কেন এসেছেন স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে নাতবে হরিহর নাথ লোকটা যে বেশ দুশ্চিন্তায় এটুকু নিশ্চিত পরিবেশ অসহনীয় হয়ে ওঠায় তাঁরা চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবেন কী তেল চিটচিটে ময়লা পর্দা সরিয়ে আস্তে আস্তে ঘরে পা রাখেন এক ভদ্রলোকবয়স আন্দাজ ষাট কী আরেকটু বেশি হতে পারে! স্পষ্ট করে বলা মুশকিল শরীরের যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে তাতে চামড়ায় অজস্র ভাঁজ চোখে পড়ছে বিশ পঁচিশ বছর কোনও ট্রাঙ্কে কাগজ বা কাপড় দলা পাকিয়ে রাখলে যেমনটা হয়! কপাল থেকে ঘাড়ের পেছনদিক তেমনই শ্রীহীনচোখে গোল গোল ঝাপসা কাঁচের ফ্রেম ভাল করে খুঁজলেও চোখের কালো মণি দুটোকে চশমার এপার থেকে বোঝা মুশকিল শরীরের গড়ন দেখলে মনে হয় তিনি বহু কষ্টে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন
'আপনার কী শরীর খারাপ অমিয়বাবু? কেমন লাগছে'
'আপনারা ফিরে যানযাদের যাদের কথা দিয়েছিআপনারা সবাই লেখা পেয়ে যাবেন!'
খুব আস্তে আস্তে কথা বলেন অমিয়বাবু
'পেয়ে যাব? কবে? ওই তো হরিহর দা দাঁড়িয়ে ওঁর মুখ থেকেই শুনেছি নববর্ষের পত্রিকা যখন ছাপতে যায় যায় আপনার গল্প হাতে পায় দাদা আপনাকে মশাই আর ঠিক ভরসা হচ্ছে নানেহাৎ...'
আচমকা লোকগুলো যে ঘরে দাঁড়িয়ে ছিলেনতার ঠিক মাথার ওপরের সিলিংয়েই অসম্ভব ধুপধাপ শব্দ হয়গোটা বাড়িটায় থরথর করে ঝাঁকুনি হতে শুরু করে সিলিং থেকে ঝুরঝুর করে বৃষ্টির মত খসে পড়ে চুন সুরকির মিশ্রণ
সর্বনাশ!
ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি?
অসম্ভব বিচলিত হয়ে ওপর দিকে তাকাতেই কমলেশবাবুর ঠিক পায়ের সামনে ঝরে পড়ে একদলা সিমেন্ট বাসটে পচা গন্ধ আর খসে পড়া চাঙ্গরের ধুলোয় হাঁচি কাশি শুরু হয়লাফিয়ে চার পাঁচ পা পিছিয়ে আসে কমলেশবাবু
কী হচ্ছে ওপরে?
'বাবাগো! আরেকটু হলে মাথায় পড়ত কী হল অমিয়বাবু? এসব কী? লেখা নিতে এসে শেষমেষ জখম হব? ঘর যে ভেঙে পড়ছে! এভাবে না থেকে বিক্রি করে দিতে পারেন তো?'
অমিয়বাবু নিরুত্তর যেন এসবে কোনও গায়-ই নেই যেমন শান্ত ভঙ্গিমায় নুয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেনতেমন করে দাঁড়িয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলে ওঠেন,
'হরিদাআমি কথা রাখবযেমন আগেও রেখে এসেছি!'
'না আসলে আমি ঠিক লেখা চাইতে...আজ'
ততক্ষণে ভয়ানক কাশতে শুরু করেছেন কমলেশ রায়
গায়ের ধুলো ঝেড়ে নাক চোখ মুছতে মুছতে হরিহরবাবুকে প্রায় হাত ধরে টেনে নিয়ে বাইরে চলে আসেন তিনি কমলেশ বাবুর বুকের মধ্যে তখনও দুরমুশ পিটছে সিলিংয়ের কোনও একটা ভারী চাঁই যদি এক্ষুণি মাথায় পড়ত?
বিকেলের আকাশ গাঢ় কমলা থেকে কালচে হয়ে আসছে মাথার ওপর ঘুরপাক খাওয়া পাখিগুলোর ডানার রংটা ঠিক চেনা যাচ্ছে নানীচ থেকে দেখে আকারে কাকের তুলনায় বড় মনে হচ্ছে যেন ওগুলো কী পাখি? পচা গন্ধটা পাতলা হয়ে এসেছে হটাৎ বাড়ির মেন লোহার জং ধরা গেটটা ঠেলে বাইরে বেরোতেই হরিহরবাবু কী যেন দেখে চোখ লাল করে পেট মুচড়ে মুখে ওয়াক তুলে বসে পড়েন রাস্তার ধারেদৌড়ে পাশে এসে দাঁড়ান কমলেশবাবু যা দেখেন তাতে ওনার শরীরটাও গুলিয়ে ওঠে
দেখেন,
একটা চেপ্টে যাওয়া বাচ্চা কুকুরের মৃত শরীর যার চামড়ার ভেতর থেকে পাকস্থলী, হৃদপিন্ড বাইরে বেরিয়ে লেগে রয়েছে রাস্তার চারপাশে রক্তে থিকথিকে মাছি এসে ভিড় করেছেচোখদুটো বেরিয়ে ঘিলুর সঙ্গে আটকে
এভাবে একটা বাচ্চা কুকুর কিভাবে মারা গেল?
বড় কোনও ট্র্যাককে তো এখানে চলাচল করতে দেখা যায় না?
চটকে যাওয়া শরীরটা একনজর দেখলে বোঝা যাবে কেউ যেন আঙুল দিয়ে ঘেঁটে ঘেঁটে কুকুরটার শরীর থেকে কিছু বের করতে চেয়েছে
গন্ধটা কী তবে এখান থেকেই আসছিল?
*********
ঠিক একবছর আগে অমিয়বাবুর অতিথি আপ্যায়ন এমনটা ছিল নামানে মিশুকে বলে খুব একটা সুখ্যাতি না থাকলেও যে ক'জন সম্পাদক, সাহিত্যিক, চেলা চামুন্ডে অমিয়বাবুকে চেনেন জানেন তাঁদের প্রত্যেকেরই যাতায়াত ছিল এখানে
লেখকের বাড়ি একটু একটেরে নির্জন জায়গায়কাছাকাছি ১কিমির মধ্যে তেমন বসত বাড়ি না থাকলেও দু'একটা দোকান চোখে পড়ে হয়ত লেখালিখির সুবিধার জন্য এমন জায়গা বেছেছেন ফাঁকা নিরিবিলিতে লেখার হাত যে খোলতাই হয় একথা তো সবাই জানে তবে একথাও ঠিক অমিয়বাবু নিজে কথা না বললেও হাসিমুখে অন্যের কথা শুনতেনবাড়িতে লোক এলে গিন্নিকে হেঁকে বলতেন,
'কই হে কোথায় গেলে? চায়ের সঙ্গে ওই যে ওই চানাচুরটা আনো দেখি আরে মনে পড়ছে না? পরশু যেটা বাজার থেকে আনলাম টক ঝাল নোনতা'
সেসব আসরে চলত গল্পপাঠচলত গল্পের চুলচেরা বিচারআবার কখনও একে অপরকে ল্যাং মারার ফন্দিওচিরকাল যা বাঙালির স্বভাব
অমিয়বাবু লেখা শুরু করেছিলেন ওনার যখন কুড়ি একুশ কলেজ থেকে বেরিয়ে আর সরকারি দপ্তরের পরীক্ষায় উঁকি দেননিকী এক জেদে কলম বাগিয়ে বসেনশোনা যায় পারিবারিক কিসের এক ছোটখাটো ব্যবসা ছিল তাইতেই মোটামুটি নুন ভাত জুটে যেত একটু একটু করে হয়ে ওঠেন সবার পরিচিত 'গল্প কাকু'; ওনার গল্পে চারপাশের ঘটনাগুলো সাজানো থাকত ছবির মত ছোট থেকে বড় কারুরই বুঝতে অসুবিধা হত নাগল্পের রূপ মার্জিত, সুললিত লিখতে থাকেন বহু প্রথম সারির পত্রিকায়প্রথমে উত্তর কলকাতার পৈতৃক বাড়িতে থাকলেও কিছুদিন পর এইদিকে চলে আসেনকেন? জানা যায় নি অনেকে কানাঘুষো করেন সম্ভবত নিঃসন্তান হওয়ার কারণেই দম্পতি নিজেদের আড়াল করেছেনহয়ত আত্মীয় স্বজনের থেকে তিতিবিরক্ত হয়েই এ সিদ্ধান্তকে জানে? বাড়ি, ব্যবসার কী করেছেন তাও অজানা
কিন্তু এখানেও বাধ সাধল নিয়তি পৈলানের পুরোনো এককামরার দোতলা বাড়িতে থাকতে তো শুরু করেনকিন্তু দু'বছরের মাথাতেই অঘটনটা ঘটে যায়
অমিয়বাবুর স্ত্রী মারা যান বাড়িতে এলে তালাবন্ধফোনের পর ফোন করেও তাঁকে আর পাওয়া যেত নাযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন সবার সঙ্গে
পুরো একটা বছর আটকা ছিলেন ঘরে একাসবার চোখের আড়ালে
তারপর একদিন হঠাৎই 'হাসিখুশির' দপ্তরে ফোন করে বলেন,
'হরিদা আমি একটা গল্প লিখেছিনেবেন?'
হরিহর নাথ হাতের চাঁদ পেয়েছিলেনইদানিং লেখকদের মধ্যে ধৈর্য্য ও পড়াশুনা দুয়েরই অনেক ফাঁক থাকেআগেকার সেই জ্ঞান কোথায়? চটক থাকলেও গভীরতা নেই অমিয়বাবু অবশ্য বরাবরই সে গোত্রে পড়েন নাযেমন তাঁর সহজ ভাষা, তেমন প্লটের গভীরতাসেটাই এতদিন খামতি ছিল পত্রিকায়
আনন্দে তুতলে বলে উঠেছিলেন হরিহরবাবু,
'হ্যাঁ হ্যাঁ নেব না কেন? নিশ্চয়ই নেব সামনে নববর্ষ এ সময় যে কী উপকার করলেনঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন, নববর্ষের স্পেশাল সংখ্যায় আপনার গল্প থাকবেআমি আজই ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিচ্ছি!'
হরিহর নাথ ঘটা করে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন,
'এবারের নববর্ষ সংখ্যায় থাকছে অমিয় সমাদ্দারের বড় গল্প!'
সঙ্গে সঙ্গে 3k লাইকশেয়ার শ'র কাছাকাছি কমেন্টের বন্যাএতদিন পর লেখক ফিরছেনতারওপর স্পেশাল ইস্যু দপ্তরের ফোন, মোবাইলে ফোনের পর ফোনকেমন গল্প? পত্রিকা কবে প্রকাশিত হবে? নানা প্রশ্নবিজ্ঞাপনটা যে এতটা ফেটে যাবে ভাবতেই পারেননি সম্পাদক
খটকাটা অন্য জায়গায়
অনেক বেশি অবাক হয়েছিলেন গল্পটা পেয়েযে মানুষটা সুললিত ভাষায় গল্পের খোশ মেজাজ ফিরিয়ে আনেন বাচ্চারা দু'গালে হাত দিয়ে গল্প শোনে তারা এ গল্প পড়বে?
এ কেমনধারা গল্প?
ভয়, চিৎকার, রক্ত গা ঘিনঘিনে উদ্ভট এক রহস্যকাহিনী
অবাক হয়েছিলেন পড়েছিলেন আতান্তরে এদিকে অমিয়বাবুর গল্পের অপেক্ষা করে করে শেষমেষ পত্রিকা প্রেসে যাচ্ছিল সেদিনই গল্প ফেরতের অবকাশও ছিল না
কিশোররা কি এমন গল্প পড়বে?
সত্যি কথা কী সম্পাদকীয় দপ্তরের বাকিদের সঙ্গে বেশ মন কষাকষি করে তবে হরিহর নাথ গল্পটা ছাপেন তবে মনে মনে এও ঠিক করেন,
'পাঠক না নিলে অমিয়বাবুকে সরাসরি জানাবেন'
কিন্তু লেখকের কপাল বেড়ে গল্প চললবলা ভাল ছুটল
ফেসবুকে একের পর এক রিভিউ হাসিখুশির বাকি পাঁচটা গল্পকে বলে বলে পাঁচ গোল দিয়েছিল অমিয়বাবুর 'বাদুড়ের চোখ'!
সত্যি পাঠক যে কি চায় আর কি চায় না স্বয়ং ব্রম্ভাও জানে না
সেই থেকে শুরু 'হাসিখুশি' থেকে 'প্রথম নৌকা', 'সবুজ মন', 'ক্লাসরুম' বিভিন্ন পত্রিকা অমিয়বাবুর গল্পের জন্য হাপিত্যেস করতে থাকে স্বাভাবিকভাবে জনপ্রিয়তায় সাংঘাতিক খুশি হন হরিহর নাথ রক্তারক্তির গল্পের ক্রেজ দেখে পত্রিকার নাম পাল্টে রাখেন 'রাত বারোটা' একদিন মিষ্টি হাতে সোজা চলে আসেন লেখকের বাড়িতেবলেন,
'আপনি তো ফাটিয়ে দিয়েছেন মশাইকিন্তু এমন একটা লেখা আপনার হাত থেকেআমি তো জাস্ট ভাবতে পারিনি'
'আমিও কী ভাবতে পেরেছিলাম?' নামানো মাথাটা দুলিয়ে দুলিয়ে বলেছিলেন অমিয়বাবু
পরিবর্তনটা যে শুধু লেখাতে নয়, অমিয়বাবুর মনেও হয়েছিল বুঝেছিলেন হরিহর নাথ ঘরের চূড়ান্ত অগোছালো ভাব দেওয়ালে নানা আকৃতির জলের নকশা, স্যাঁতস্যাঁতে জলো ভাবথেকে থেকে হাওয়ার মত নাকে ঝাপটা দেওয়া পচা গন্ধ মশা মাছির তুমুল ভিড় দেখে যেকোনো সাধারণ মানুষই বুঝবে অমিয়বাবু ভাল নেই অমিয়বাবু যে পুরোনো বাড়িতে থাকছেন সবাই জানতেনকিন্তু এমনতরো অপরিচ্ছন্ন আগে ছিল নামধ্যবিত্ত হলেও ঘরদোরে যে ছাপোষা শ্রী ছিল তা যেন কোন ম্যাজিক শোয়ের মত একচুটকিতে গায়েবভদ্দরলোকের জীবনটায় হাসি হারিয়ে দমকা একটা কালো ঢুকে পড়েছে হুড়মুড়িয়ে সেদিন নিজের আনা মিষ্টির সবকটাই বড় বিস্বাদ ঠেকেছিল হরিহরবাবুর বেশি কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিলেন বাড়িতেমনে মনে ঠিক করেছিলেন, 'অমিয়বাবু নিজে থেকে না দিলে আর লেখা নিয়ে তেমন জোর করা ঠিক হবে না'
এটা তো ঠিকইহরিহরবাবুর নিজেরই কেমন কেমন লাগে যখন গিন্নি ৫দিনের নাম করে ১৫দিন বাপের বাড়ি কাটিয়ে আসেনতবুও তো তাঁর দুই গাধা ছেলে বাড়ি থাকেহায়! অমিয়বাবু তো সে সুখ থেকেও বঞ্চিত
হঠাৎই একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছিলসবেমাত্র বিকেলের চা নিয়ে বারান্দায় বসেছিলেন হরিহর নাথ
'হ্যালো!'
'কে?'
'আমি বিনয়!'
'বিনয়?'
'আরে চিকুকে ভুলে গেলে জামাইবাবু? কণাদির মামাতো ভাই'
'এতদিন পর? মিডিয়ার ব্যস্ত মানুষবাপের শ্রাদ্ধ হলেও তো তোমাদের দেখা পাওয়া যায় না'
'কী যে বলো জামাইবাবু মানুষের জন্যই তো আমাদের কাজআমার ছেলে সৌরভ সেভেনে পড়ে 'হাসিখুশি' পড়ে নিয়মিত'
'তা বেশ শুনে ভালোলাগলো এতদিন কোনও খবর নেই হটাৎ কী মনে করে শালা?'
'এ মা ছি ছি গাল দিয়ো না জামাইবাবুবিষয়টা তোমার পত্রিকা নিয়েই কাল রবিবার সপরিবারে জ্বালাতে আসছি কেমন?'
ফোনটা কেটে যায় হরিহরবাবুর ছোট্ট 'হ্যাঁ'র পর
ডাক নাম চিকুভাল নাম বিনয় পোদ্দারহরিহরবাবুর সম্পর্কে শালা'খবর বাংলা'র নিউজ এডিটরএসব লোক তাঁর মত শখে সাহিত্য করা লোকজনের কাছে খুব একটা আসেন নাতবে? উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছিলেন ফোনটা আসার পর থেকেইব্যাপারটা ঠিক এই খাতে বইবে আশা করেননি
রবিবার বিনয় এসেছিল সপরিবারেই
বলেছিল,
'জামাইবাবু আপনি তো সাংঘাতিক কান্ড করে বসেছেন!'
'কী ব্যপার বলো তো চিকু? আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি নাপত্রিকা নিয়ে কী এমন কথা থাকতে পারে যে...!'
'বাদুড়ের চোখওটা তো ঠিক গপ্পো নয়!'
'এ্যা! কী হেঁয়ালি হচ্ছে খুলে বলো!'
'বলছিতার আগে এটা পড়ুন'
চিকু ব্যাগ থেকে একটা খবরের কাগজের ভেতরের পাতা এগিয়ে ধরে তাঁর জামাইবাবুর দিকে
ভুরু দুটো কাছাকাছি চলে এসেছিল হরিহর নাথেরচশমাটাকে নাকের সামনে থেকে ঠেলে পেছনের দিকে তুলে পড়তে শুরু করেছিলেন ছাপার অক্ষরগুলো
যত সময় যাচ্ছিল কী এক চরম উদ্বিগ্নতা ফুটে উঠছিল হরিহর নাথের সারা মুখময় কপালে জমতে শুরু করেছিল বিন্দু বিন্দু ঘামএও কী সম্ভব?
একেবারে হুবহু শুরু থেকে শেষ গোটাটা জায়গা এমনকি চরিত্রের নাম সব সওওওবব?
খবরটা এইরকম,
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার পাঁচবেড়ে এলাকার যদু কলোনির এক উঁচু ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে ঝাঁপ দেয় রুমকি সাহা নামে এক কিশোরীবয়স ১৭সারদা বালিকা বিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রীশুক্রবার ভোর ৫টা নাগাদ ফ্ল্যাটের পেছনের দিকে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়অনুমান ভোররাতের দিকে কোনও এক সময় ছাদ থেকে ঝাঁপ দেয় মেয়েটি প্রতিবেশী এবং পারিবারিক সূত্রে যেটুকু জানা যায় রুমকি পড়াশুনায় যথেষ্ট ভাল ছাত্রী ছিল পরিবারের সঙ্গে বিশেষ কোনও মনোমালিন্য ছিল না কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা মৃতদেহ অদ্ভুতভাবে বিকৃত পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট এলে সবটা পরিষ্কারভাবে জানা যাবেতদন্ত চলছে'
কাগজটা মুড়ে টেবিলে রেখে দিয়েছিলেন হরিহরবাবু
বলেন, 'এটা একটা কোইনসিডেন্ট'
'হুম আমিও তাই ভেবেছিলাম জামাইবাবুআমার ছেলে পিকলু এসে যখন গল্পটা শোনায় ঠিক ধরতে পারিনিকিন্তু যখন বইটা নিয়ে পড়ি এতটা মিল?'
অস্বস্তি লাগছিল হরিহর বাবুরএই মিডিয়ার লোক ছুতো পেলে হয়কে নয়, নয়কে হয় করে কাগজের টিআরপি বাড়ানোর জন্যতাঁর সামান্য সরকারি চাকরিশখে এসব সাহিত্যে ঘোরাঘুরিএরপর যদি শালাবাবু পেছনে লাগেযা এ কয়দিন লোকে কিনে পড়ছে তাও ভোগে যাবেবলেন,
'দেখো ভাই অনেক লেখকই কাগজের খবর দেখে গল্প লেখেন এতে দোষের কী আছে?'
'সেটা আমি জানি কিন্তু একটা জিনিস কী খেয়াল করেছেন? আপনার বইটা প্রকাশ পেয়েছে ১৫ই এপ্রিল আর খবরটা ওই তো হাতেই আছে দেখুন দেখুন ১৭ই এপ্রিল'
'কিন্তু তাতে কী?'
'তাতে অনেক কিছুইআমি খবরটা কভার করতে গেছিলাম কারণ একটাইকেসটায় একটা নতুন গন্ধ পেয়েছিলামএক নম্বর মেয়েটার বডি সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত চোখে দেখা যায় নাঅন্ত্র সমেত সব বেরিয়ে ঘাস গাছে লেগে দ্বিতীয় মেয়েটার একটা ডায়েরি পাওয়া গেছে যেটা কাগজে লেখা নেই ওটায় ও নাকি সারাক্ষণ একটা কিছু দেখত ঘুমাতে পারত নাখেতে পারত নাকী দেখত সেটা ক্লিয়ার নয় তবে অনেকটা নিশাচরের জ্বলন্ত চোখের মত মানসিক দিক থেকে ভেঙে পড়ছিল কি কোনও কারণে? ঠিক কী? এই এই ব্যাপারটাই আমাকে ভাবিয়েছে ভাবতে বাধ্য করেছে পুরো যে ওই গল্পটা প্লিজ জামাইবাবু আমি একবার লেখকের সঙ্গে দেখা করতে চাই'
হরিহরবাবু কেঁপে উঠেছিলেন পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘাআর মিডিয়ায় ছুঁলে! কত ঘা কে জানে?
কী বিপদ! কী বিপদ!
ম্যানেজ করে বলেন,
'শোনো তাহলে খুলেই বলিলেখকদের মাথার হদিশ কে কখন দিতে পেরেছে? তেমন সিরিয়াস কিছু নয় ভদ্রলোক সদ্য স্ত্রী হারিয়েছেন একটু ঘেঁটে আছেনতাই এসব! এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে খামোকা... তুমি চিন্তা করো নাআচ্ছা আমি নাহয় একবার ওনাকে জিজ্ঞেস করব গোবেচারা মানুষ আমার কাছে যতটা সহজ হবেন তোমার কাছে তো নাও হতে পারেন'
আশা করাই যায়সেদিন হরিহরবাবুর কথা তেমন মনে ধরেনি বিনয়ের
দেড় ঘন্টা মত আড্ডা, এদিক সেদিক কথা বলে বাড়ি ফেরার পথে বলেছিল,
'জামাইবাবু বেশ বেড়ে সম্পাদক হয়েছেন'
তিনি উত্তরে কিছু বলেননিমনের মধ্যে একটা আলগা পেরেক গেঁথে গেছিলখচখচ করছিল
কি করে এতটা মিল?
তবে ঠিক করেছিলেন ব্যাপারটা কোনোমতেই কানাকানি হতে দেবেন না অমিয়বাবুকেও এখনই কিছু বলবেন না এমন তো নয় যে একটা গল্প মিলেছে বলে সবকটা গল্পই মিলবে? আরেকটু দেখাই যাক নাতারপর না হয়...!
হাজার হোক বছরখানেক পর পত্রিকার সার্কুলেশন দ্বিগুণ তো হয়েছে
***********
এরকম করেই কাটছিলহটাৎ এর মধ্যেই আরেকটা ঘটনা সামনে আসে
দিনটা ছিল নববর্ষের এক দু'মাস পর একটা শনিবারএইসময়টায় হরিহর বাবুর দপ্তরে জমায়েত হয় অনেকেই ওই আসছে পুজোসংখ্যার গতিপ্রকৃতি কেমনধারা সেসব নিয়ে একটু আলোচনাদপ্তর বলতে হরিহর নাথ বাড়ির একতলাটা গুছিয়ে নিয়েছেন নিজের মত করেবেশ কয়েকটা নতুন ধারার পত্রিকার লেখক সম্পাদকও আসেন
একথা ওকথার পর 'সবুজ মনে' সম্পাদক নিখিল দেব বলেন,
'দাদা অমিয়বাবুর মাথায় কি ছিটটিট হয়েছে নাকি?'
'কেন বলোতো?'
'আর বলবেন না; সেদিন আমার মোবাইলে ফোন করেছেনআমি তো প্রথম চোটে একটু অবাকই হয়েছিলামআর কী বলব? ওনার স্ত্রী বেঁচে থাকাকালীন একটা সাম্মানিক দেওয়া হয়নিভাবলাম আগের ডিউটা চাইতে ফোন করেছেন কোনোরকমে কেটে বেরিয়ে ফোন রেখে দেব ভাবছি ওমা দেখি ওসব কোনও কথাই নয়সিধে আমাকে বলেন, 'আমি একটা গল্প লিখেছি নেবেন?'
'সে কী? তোমাকেও?'
'হ্যাঁ আমাকেও'
'তা তুমি কী করলে?'
'বললাম পাঠিয়ে দেন অমিয়দা বললেন ইন্টারনেট চলছে নাএখন ডাকে যেতেও পারবেন না কী একটা অসুবিধা আছেআমি যদি কাউকে পাঠিয়ে নিয়ে যেতে পারি আজব! সত্যি কথা বলতে আমার খুব একটা ইচ্ছে যে হয়েছিল এমনটা নয় দেখছ তো যা বৃষ্টি চলছে তার মধ্যে বাড়ি অফিস সামলে কে আর ধারধারা গোবিন্দপুরে গল্প নিতে যায়? চিন্তা করলুমশেষমেষ ভাবলুম তুমি আমাদের বড়দা যখন সাহস করে 'বাদুড়ের চোখ' ছেপে রাতারাতি ফেম পেলেআমার এই কচি বুকে আর সাহস দেখাই কেন?'
'শেষমেষ গেলে?'
'হ্যাঁ গেলুম বাড়ি চিনতে তো অসুবিধা হয়নিআগেও গেছিলুম কিন্তু বাড়ির ওই হাল হয়েছে জানলে আর ওই চত্বর মারাতাম নাবাড়ি ঢুকতে যাব দেখি একখান মরা কাক ঘেঁটে থেঁতলে পড়ে আছে কী অপয়া কান্ড! ভাবলাম আজ আর গপ্পো পাবার আশা নেই ভেতরে ঢুকে দেখলাম অমিয়দাও যেন কেমন একটা হয়ে গেছেন কিন্তু জানো গপ্পো আমি পেলুমএখনো সেইরকম একতাড়া কাগজ আমার হাতে গুঁজে দিলেন বিশেষ কিছু কথা আর হয়নিচলে এসেছিলুম'
'গল্পটা ছেপেছ?'
'হ্যাঁ ছেপেছি আর ছাপতেই তো যত বিপদঅমিয়দা গল্পটা লিখেছে বটে কিন্তু লিখেছে না বলে ওটা টুকেছে বলাই ভাল'
'মানে?'
'মানে টিভির একটা খবর এ টু জেড টুকে দিয়েছে ভদ্দরলোক'
'খুলে বলোতো?' হরিহরবাবুকে উদ্বিগ্ন দেখায়
'আর বলবেন না সবুজ মনে অমিয়দার গল্পটা বেরোনোর পর আমার স্ত্রীই ডেকে নিয়ে দেখায় খবরটা টিভিতে দেখাচ্ছিল আপনি দেখেন নি? ওই যে ডায়মন্ড হারবারে রোডে এক মহিলা একা থাকতেন কল সেন্টারে না কোথায় কাজ করতেনরাত করে বাড়ি ফিরছিলেনদেহটা পাওয়া গেছে মহিলার ফ্ল্যাটের থেকে কিছুটা দূরেই আশ্চর্যের ব্যাপার হল মহিলাটার হাতের দশ-দশটা আঙুলই কাটা ছিল আর পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে সব সমেত চাপ চাপ রক্ত লেগে ছিল রাস্তায় পুলিশ বলছে একা মেয়েমানুষ থাকতকোনও পুরোনো প্রেমিক হয়ত রাগে এসব'
'আসলে তোমার বৌদির শরীরটা ইদানিং ভাল যাচ্ছে নাতাই আর খবর টবর সেভাবে দেখা হয়ে ওঠে নাতোমার পত্রিকাটা একবার দেবে? পড়তাম তাহলে সঙ্গে আছে?'
'হ্যাঁ হ্যাঁ নিন নাএইতো'
হাত বাড়িয়ে পত্রিকাটা নিয়েছিলেন হরিহরবাবু চিকুর কথায় যে আতঙ্কের রেশ ধামাচাপা দিয়েছিলেনসেটা আবারও ওঠানামা করছিল পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে কানের পাশ দিয়ে গড়ানো ঘামটা কোনোরকমে মুছে কিছুক্ষণের মধ্যে অফিস বন্ধ করে দিয়েছিলেনবারবার মন চলে যাচ্ছিল গল্পটার দিকেরাতে খাওয়া দাওয়া সেরেই বসে গেছিলেন গল্পটা ঠিক এইরকম,
'ওরা কে বা কারা আমি ঠিক জানি নাতবে ওরা যে সবসময় আমাকে লক্ষ রাখছে আমার পিছু নিয়েছে এটা সত্যিএকদিন পুলিশেও ডায়েরি করতে গেছিলাম কিন্তু তেমন কিছু ঠস সবুদ দিতে না পারায় পুলিশ শুধু আমার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার নিয়েই রেখে দিয়েছে আমার কাউকে সন্দেহ হয় নাসবাই তো আমাকে ভালবাসে কে মারতে চাইবে আমায়?
শিউলি সোম আমি ছোট থেকেই পিসিরবাড়ি মানুষবাবা মাকে চোখে দেখিনি একা থাকার অভ্যাসটা তো আমার বরাবরইকিন্তু এখন এত ভয় করে কেন?
যতটা পারছি পা চালিয়ে হাঁটছি আমার মনে হচ্ছে ওরা ধারেকাছেই কোথাও আছেতবে একয়দিনে বুঝেছি ওরা আলোকে ভয় পায়তাই আমি আলো ঘেঁষে হাঁটছি ল্যাম্পপোস্ট বা আধশাটার টানা দোকানগুলোর গায়ে গায়ে পা রাখছি অফিসের ক্যাবটা আজ এতটা দূরে নামিয়ে দিল বাড়ি পৌঁছতে আরও পাঁচ মিনিট
একি? এত ঠান্ডা হাওয়া বইছে কেন? বৃষ্টি নামবে কি? ছাতা তো নেই আমার খুব ভয় করছে
আর তারপরেই কান ফাটানো শব্দ করে চারদিক আলো করে বিদ্যুৎ চমকায়পেছন ফিরে কী যেন একটা দেখে দৌড়তে শুরু করে মেয়েটা কাঁদতে থাকেকান্না আর বৃষ্টি ছাপিয়ে আচমকা আরেকটা আওয়াজ শুরু হয়একটা গজড়ানোর শব্দ যেন যেন কারুর খুব রাগ হয়েছে আরও জোরে বৃষ্টি নামেতার সঙ্গে লাগাতার করকর শব্দে মেঘ ঘষাঘষি বাজ পড়তে শুরু করে
নিভে যায় শহরের সব ক'টা আলো
আর তারপরে ভয়ানক এক আর্ত চিৎকার
সকালে উঠে সবাই শিউলিকে খুঁজে পেয়েছিল রাস্তায়ও তো ছিলই নাছিল না ওর যে ক'টা আঙুল আলো খুঁজেছিল সবক'টাই'
নিম্নচাপের বৃষ্টিটা গোটা শহরটাকে ভিজিয়ে দিয়েছেকখন যে এতটা রাত হয়ে গেছে বুঝতে পারেননি হরিহর বাবু দূরে কোথায় একটা কুকুর গলা ছেড়ে ডাকছে ওনার নিজের গলাটা শুকিয়ে গেছে ঢকঢক করে জল খান এসব কি লিখেছেন অমিয়বাবু?
প্রথমে চিকু তারপর সুনীল জানতেই হবেঅন্ততঃ একটা প্রশ্ন তো করতেই হবে
***************
'এখন কেমন আছ?'
'ভাল গো! আগের থেকে অনেকটা ভাল কাল খুব বৃষ্টি হয়েছে না গো? বাজ পড়ছিলজানো বাজ পড়লেই আমার খুব ভয় করে'
'পলা এত ডিপ্রেসড হচ্ছ কেন? আমি তো তোমার সঙ্গেই আছি নাকিপুজো আসে আসেএখন এত বৃষ্টি আগে দেখিনিমোড়ের দেবদারু গাছটা অর্ধেক পুড়ে গেছে এই পলা লক্ষ্মীটি আমি তাহলে একটু নীচে যাই? অফিসে কিছু লেখা এসে জড়ো হয়েছে পত্রিকার কাজটা অনেকটাই বাকি আমি বরং সুবিকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি'
'আমাকে একটু টিভিটা চালিয়ে দেবে?'
'আর বলো না'দিন থেকেই টিভির কানেকশনটা বন্ধ ছেলেগুলোকে ডাকছি আজ আসব কাল আসব বলে কাটাচ্ছে দাঁড়াও নীচ থেকে পেপারটা দিয়ে যাচ্ছি দেখো কিছুক্ষণ'
বেডরুমের দরজা ভেজিয়ে একতলায় নেমে আসেন হরিহরবাবু যা গেল এ ক'দিন বলার মত নয়সেদিন অমিয়বাবুর বাড়ি থেকে ফেরার পর পলা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সারা ঘরময় বমি করে ভাসিয়েছিল অ্যাম্বুলেন্স ডাক্তার নার্সিংহোম কোনও কিছুই বাকি রাখেন নি  ফুড পয়জনিংটা একসপ্তাহ আগেই হয়েছিল ওষুধ পড়া সত্ত্বেও কিছুতেই করছিল নাআজ সকাল থেকে একটু বেটার সবে বসার ঘরের দরজাটা খুলেছেন হরিহর নাথ,
'বাবা ও বাবা চিকুমামা ফোন করেছে খুব দরকার তুমি ফোনটা ধরো'
'চিকু? এখন? আবার কী হল?'
'হ্যালো!'
'শুনেছেন জামাইবাবু? আপনি বাড়িতে না ওখানে?'
'মানে?'
'সেকি আপনি জানেন না? লেখক অমিয়বাবু আর নেই!'
'কী বলছ কি তুমি? আমি পরশুই গেছিলাম ওনার বাড়ি উনি কথা বললেন'
'ঠিকই বলছি! বাড়ির মধ্যে থেকে পচা গন্ধ আসছিল বাড়ির ঠিকানাটা জানার পর আমার সন্দেহ হয়ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে আমাদের জুনিয়র জার্নালিস্ট গেছেফোনটা ছাড়ছি ইউটিউব চালান লাইভ দেখাচ্ছে চ্যানেলে'
কাঁপা হাতে ফোনের ওয়াই ফাই অন করেন হরিহর নাথ
'খবর বাংলাকত লোককত লোক গিজগিজ করছে হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ ঐতো ঐতো দেখতে পাচ্ছে অমিয়বাবুর বাড়ি চারদিকে গাছপালা আগাছার দলা গায়ে মেখে মৃত কবরের মত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আর ঐটা ঐটা কী দেখাচ্ছে রিপোর্টার ছেলেটা ডানপাশের ভলুমটা আরেকটু বাড়ায় হরিহর নাথ!
'আপনারা দেখতে পাচ্ছেন আমরা চলে এসেছি সাহিত্যিক অমিয় সমাদ্দারের বাড়ি ইনি শিবু রোজ এখান দিয়েই সাইকেলে খবরের কাগজ বিলি করে বেড়ান অমিয়বাবু কাগজ নিতেন নাকিন্তু কালকের বৃষ্টিতে এতটাই গাছপালা উপড়ে পড়েছে বাড়িটাকে ঘিরেরাস্তা পেরোনোর উপায় ছিল না সাইকেল থেকে নামতেই গন্ধটা পান গন্ধটা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দেন ঠিক কি হয়েছিল আমরা শিবুবাবুর মুখ থেকেই শুনে নেব
'আমি তো রোজই যাই জানতাম লোকটা খ্যাপাটেআগে একটা বউ ছিল এখন দেখি নামাঝে মাঝে বাড়ির চারধারে ঘুরতে দেখতুম আজ একেবারে সব দিক তছনছ এত বিচ্ছিরি গন্ধ সবাই বলছে কালকের আগে মারা গেছে লোকটা ঘরের মধ্যেই ছিল বডিটা'
'আচ্ছা উনি কোনোদিন আপনার সঙ্গে কথা বলতেন না?' কথাগুলো শুনতে শুনতে ধপ করে সোফায় বসে পড়েছিলেন হরিহর বাবু
বড্ড ভারী হয়ে আসছিল বুকের মধ্যেটা
আরও কী একটা দেখাচ্ছে খবরে
'আমরা চলে এসেছি বাড়িটার পেছনে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন বিশাল একটা গর্তসুজিত ক্যামেরাটা আরেকবার ধরো; গর্তটা ঠিক যেন অনেকটা হাতের মত ছড়িয়ে বাড়িটাকে ঘিরে রয়েছে এখানে এই গর্তটা কিভাবে হল? তাহলে কি কলকাতা শহরের কাল যে বাজ পড়েছে তাতেই কোনোভাবে এই গর্তের সৃষ্টি?'
রিপোর্টার ছেলেটা আরও কী কী সব বলছিল; কথাগুলো কেটে কেটে যাচ্ছিলকয়েকটা শব্দ কানে আসছিল শুধু
এলাকার মানুষ সন্দেহ করত প্রায়ই বাড়ির চারপাশে মৃত পশু পাখি থেঁতলে... তাহলে কী উনি কোনও ভয়ঙ্কর জন্তু পুষেছিলেন? একটা শব্দ আসত প্রায়ই...! ওনার স্ত্রী কিভাবে মারা গেছিলেন? নাকি লেখক মানসিক দিক থেকে কোনোভাবে? সবটাই তদন্ত সাপেক্ষ
বুকের মধ্যেটা জট পাকিয়ে যাচ্ছিলকে যেন বেল বাজাচ্ছে টলতে টলতে গিয়ে ড্রয়িংরুমের বাইরে পা রাখেন
'পোস্টম্যান! হরিহর নাথ বাবু? একটা স্পীড পোস্ট আছেকালকেই আসতাম এত ঝড় জল শুরু হল সকাল থেকেপাঠিয়েছেন অমিয় সমাদ্দার'
আঁতকে ওঠেন হরিহর বাবু সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়মুহূর্তে সব শক্তি হারিয়ে যায়কোনোমতে শক্তি জড়ো করে খানিকটা বাধ্য হয়েই বাদামি খামটা ধরেনহঠাৎই যেন কেউ সব রক্ত শুষে নিয়ে সম্পূর্ণ একা নির্জন বালিয়াড়িতে দাঁড় করিয়ে রেখে গেছে হরিহর নাথকে
খামটার ওপর বড় বড় হরফে লেখা
(পুজোসংখ্যার গল্প)
পরশু দিন যে মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন সে কী করে?
তাহলে কি অমিয়বাবু জানতেন?
হরিহরবাবু নিজে নয়যন্ত্রচালিতের মত তার হাত খামের মুখ ছিঁড়ে বের করে আনে একতাড়া সাদা কাগজ;
'হ্যাঁ আমার ডাক এসেছেভুল বললামডাক এসেছেডাক এসেছে আমাদের দুজনের কাছেইআমি একা হলেই ডাকটা হেঁটে চলে বেড়ায় আমার সামনে এসে দাঁড়ায় পুরো শরীর দিয়ে একটা মেয়ে মানুষের রূপ নেয় আমাকে ছুঁতে চায়আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়ওকে তখন অনেকটা সৌমীর মত হয়ে যায়অনেকটা কেন ওতো সৌমীইও আমার সৌমীকে নিয়েছে আমার প্রিয় সব কিছুকে নিচ্ছে আমার ছোট্ট ভুলুকেও নিয়েছে নিয়েছে টিয়াটাকেওআমি ওকে সবার থেকে লুকিয়ে রাখি সবার চোখের আড়ালেও থাকতে চায় নাওর খিদে কমছে নাবেড়েই যাচ্ছে বেড়েই যাচ্ছে হ্যাঁ ও খুব আলো খেতে ভালোবাসে ও বলেছে ও সবাইকে নেবেওর কাছে নেবে এই পৃথিবীতে যা কিছু আলো যা কিছু ভালো তাই ও গিলে খেতে চায়যত খায় তত ওর গলা বুজে আসে ঘরঘর ঘরঘর শব্দটা অনেকটা যেন হাজার তুফানের মত শোনায়দু'হাতে কান চেপে ধরি ওই শব্দ সরে না নড়ে নাযত বেশি শব্দ তত বেশি আধখাওয়া নাড়িভূরি যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বেরিয়ে আসে ওর মুখ দিয়ে যা কিছু ও খায়সব বেরিয়ে আসে আমি কাঁদিসৌমিও কাঁদেসৌমী শব্দের গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়পারে নাকাঁদতে কাঁদতে বলে অমিয় পালাও পালাও পালিয়ে যাও আমি পালাতে পারি নাযদি সত্যি একদিন সৌমী ফিরে আসে আমার চুপ পৃথিবীর কোণায় দাঁড়িয়ে বলে অমিয় তুমি আবার আগের মত সব ভাল গল্প লেখোআলো গল্প লেখোএমন গল্প তো তুমি লেখো না আর? এ কোন অমিয় এ অমিয়কে আমি চিনি নাআমি বলি আমি গল্প লিখি না সৌমীআমি তো সত্যি লিখিযেদিন রাতে পাঁচতলা থেকে রুমকি উড়ে উড়ে পড়েছিল আর শব্দ ওর গলা ছিঁড়ে আলো খেয়েছিলসেদিন আমি সব দেখেছি দেখেছি ওই যে মেয়েটা হেঁটে হেঁটে ফিরছিল ওর সব ক'টা আঙুল গিলে নিল রাক্ষুসীটা কিভাবে তোমাকে মেখে তোমার নরম চুল মেখে আস্ত একটা জ্বলজ্বলে পিশাচিনি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজ
ও চলে যাবেখুব তাড়াতাড়ি চলে যাবেতবে তুমি যে ওর মধ্যেইআমি তোমাকে ছাড়া থাকব কি করে সৌমী! আমিও যাব
সৌমী আমরা একটা নতুন সকাল দেখবওর দেশের সব কালো মিলিয়ে একটা আলো সকাল তৈরি করব আমরা আর তারপর... একে একে ফিরিয়ে দেব সব আলো প্রাণ
কিন্তু ওই যে ওই যে ও যে আমাকে নিতে আসছে আহ
'আহ... গল্পটা শেষ হওয়ার আগেই যন্ত্রণায় একটা কাতর কন্ঠস্বর শুনতে পান হরিহরবাবু
পলা কি হল ওর?
পলার কী হল?
প্রায় এক নিঃশ্বাসে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শুনতে পান একটা শব্দ
ঘর ঘর ঘরঘর ঘর ঘর...!

(সমাপ্ত)


গল্পটি শুনতে চাইলে নিচের link  এ click করুন


Comments

Popular posts from this blog

‘জায়গাটার নাম ম্যাজিক’

বসন্ত আসেছিল তাদেরও মনে । গল্পের নাম - "রাজা,রানী ও সিপাহী"