"বইপোকা"




মুখ হাঁ করা একটা বই টেবিলের উপর রাখাঘুলঘুলি দিয়ে সকালের সরু হলুদ আলোর সমান্তরাল রেখা এসে পড়েছে বইয়ের পাতার উপর। ভ্যাপসা বাসটে একটা গন্ধ পাক খেতে খেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে গোটা ঘরটায়। ছেঁড়া ছেঁড়া আলোরা নিজের জায়গা খুঁজছে। যেন তারা গোটা ঘরটায় একটা প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছে
হঠাৎ একটা শব্দ! একটানা, একঘেঁয়ে কিন্তু কান পাতলে শোনা যায় এমন!
শব্দটা এলোমেলো উড়তে উড়তে এসে বসে খোলা পাতার ঠিক মাঝখানেছেঁড়া ছেঁড়া শব্দগুলো জটলা বেঁধে চলেছে যেন! একঘেঁয়ে শব্দটা জড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে কালো একটা কিছু চোখের সামনে স্পষ্ট হতে শুরু করেতাহলে কি শব্দটার প্রাণ আছে...? জীবন্ত শব্দঘোর যান্ত্রিক ড্রিল মেশিনের মত প্রাণপণ কুড়ে চলেছে গভীরে, আরো গভীরে! একটু একটু করে দেবে যাচ্ছে, বসে যাচ্ছে পাতার কাগজ! কালো প্রাণীটার শরীরের চারপাশে জমা হয়ে চলেছে পাতার ছেঁড়া টুকরোগুলো তাহলে কি প্রাণীটা...? আর ঠিক তখনই একটা হাত সজোরে এসে পরে জীবন্ত কালো প্রাণীটার উপর। থেঁতলে যাওয়া প্রাণীটা হাতের আঘাতে ছিটকে যায় পাতার ধারে এক টোকায় মরা প্রাণীটাকে বই থেকে টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে কেউ যেন বন্ধ করে বইয়ের মলাট। মলাট থেকে হাওয়ার মত ধুলো উড়ে মিশে যায় উড়ে বেড়ানো ছেঁড়া আলোর সঙ্গে! আধো আলো, আধো অন্ধকারে পরিষ্কারভাবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না! মনে হয় টেবিলে বন্ধ করা বইটা ঘষটে টেনে তুলে নিল কেউআবঝা একটা শরীর একটু একটু করে আলো থেকে সরে অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে
(১)
(দিনের শুরু)
"দ্যাখ্ বাবু, দেখে শেখ। এত বড় হয়ে গেলি। তাও তোকে বলে বলে পড়াতে বসাতে হবে! আর ঐ মেয়েটা যখনই দেখি, শুধু বই আর বই। এক মুহূর্ত বই ছাড়া চলে না। কে বলবে ওর বাবা-মা নেই। এই তো দ্যাখ কি সুন্দর লক্ষ্মী মেয়ের মতো বই হাতে পড়তে যাচ্ছে।" উত্তরোত্তর গলা চড়িয়ে মা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে, কোন এক লক্ষ্মী মেয়ের গুণকীর্তন করতে করতে সমানে শাসনের ফরমান জারি করে চলল।
আমি কি করি! মাথা পেতে শান্ত ছেলের মতো একের পর এক অপরাধ কুড়িয়ে বাড়িয়ে জ্যামিতি বক্সে ঢোকাতে থাকলাম।
আজকের বড় অপরাধ, অঙ্ক স্যারের ক্লাসে যেতে একটু লেট হয়ে গেছে। টুকাই খেলতে ডেকে নিয়ে গেল, বিপত্তিটা সেখানেই। তারপরেই মায়ের বকুনি শুরু এই সময়টায় মা আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে পাড়ায় সমস্ত পন্ডিত পড়ুয়ার উদাহরণ টেনে এনে সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় কোনো ওজর অজুহাত আপত্তি কিছুই খাটে না সেসময়! বরঞ্চ মাথা পেতে সবটা অপরাধ মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ! তাই আমিও আর কথা বাড়ায়নি
চটপট ব্যাগ গুছিয়ে দৌড় লাগালাম। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটা ছুঁই ছুঁই। বাড়ি থেকে স্যারের কোচিং মিনিট পাঁচেক সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে রতনদের ক্লাবঘরের সামনে আসতেই বেদম ধাক্কা! উফঃ কি বিপদ! একে দেরি তার উপর...!
"দেখে চলতে পার না? খুব জোর ব্রেকটা দিয়েছি নাহলে আর একটু হলেই..."
আগে দেখেছি বলে তো মনে হচ্ছে না! মেয়েটা কে? মা যদি জানতে পারে আমি আবার লোকজনকে সাইকেলে ধাক্কা দিচ্ছি চলাফেরার পথেতাহলে আর রক্ষে থাকবে নামেয়েটা কথা বলছে না কেন? লাগল নাকি?
থতমত খেয়ে বলি, "দেখে হাঁটবে তো...! লাগেনি তো কোথাও?"
ঘাড়টা অল্প করে নাড়াল শুধু নীচু হলাম একটু মুখটাও ভালো করে দেখতে পেলাম নাএকমাথা চুল পাখির বাসার মত ঝাপড়া হয়ে রয়েছে মেয়েটার কপাল মুখ আগলে! কথা বলতে পারে না? কার মুখ দেখে যে ঘুম থেকে উঠেছিলাম 'হ্যাঁ' বলল নাকি 'না' আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম নাকিন্তু এবার আর দেরি করতে পারব নাস্যার ঘাড় ধরে কোচিং ক্লাসের দরজার বাইরে বের করে দেবে
আমি আরেকবার মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলামকিন্তু এবারেও যখন একইরকম ঘাড় হেলান দেখলাম দাঁড়িয়ে না থেকে প্যাডেলে চাপ দিলাম। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। সাঁই সাঁই করে সাইকেলের চাকা ঘুরিয়ে মন্টু কাকুর দোকান পেরোতেই ঠান্ডা একটা হাওয়া পিনের মতো বিঁধতে শুরু করে দু-কানের পাশে বৃষ্টি নামবে? একে কলকাতায় এমন বিপদজনক শীত ভালোলাগে নাতারপর জানুয়ারিতে বৃষ্টি? মাথার টুপিটা টেনে কানদুটো ঢাকলাম। এই সকালেও রোদ কমে এসেছে! ভালোমত রোদ দেখা যায় এই সময়টায়! কিন্তু গোটা রাস্তাটায় পাতলা একটা ধোঁয়াশা ঘিরে রয়েছে। আরেকটু! এসে গেছি! সাইকেলটা দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে জুতো খুলতে খুলতে মনে হল! মেয়েটা যদি আমার বাবা-মাকে গিয়ে নালিশ করে? তেতোর দলা আটকে রইল গলার মধ্যেটা! আচমকাই মেঘলা ধোঁয়াশা ভেদ করে তীক্ষ্ণ বৃষ্টির দাপুটে ঠান্ডা জল আমার গায়ে এসে পরতে শুরু করল আমি তাড়াতাড়ি ঢুকে ক্লাসের দরজা বন্ধ করে দিলাম!
(২)
(পরেরদিন)
"কি নাম তোমার? তুমি খুব বই পড়তে ভালোবাস? কালকের ঘটনাটার জন্য আমি সত্যি খুব সরি! আসলে কোচিং-এ এত দেরি হয়ে গেছিল! তুমি কি বই কিনতে এসেছ? গল্পের নাকি পড়ার কোনো...!" কথাগুলো একনাগাড়ে বলে দম নিলাম আমি মানে আর্য। কিন্তু উত্তরে আজও সেই একই ঘাড় নাড়া ছাড়া কিছুই পেলাম না। মুখটাও ঝুলো মার্কা চুলে ঢেকে রয়েছে ড্যাবা ড্যাবা, ফোলা ফোলা একটা চোখ শুধু চুলের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে উঁকি মারছে! মেয়েটা আমার হাতের বইটার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে! আমি 'ফটিকচাঁদ' বইটা তুলে দেখালাম ভাবলাম ও হয়ত নিতে চায় বইটা! কিন্তু তাও একইভাবে তাকিয়ে...!
স্ট্রেঞ্জ!
পড়তে পড়তে কারুর যে এ অবস্থা হয়! এই প্রথম দেখলাম, জানলামমনে মনে বেজায় রাগ হলপড়তে ভালোবাসতেই পারে! তাই বলে বই জাপটে, বই বগলে নিয়ে সারাক্ষণ ঘুরবে! এই লোক দেখানো ব্যাপারটা বড়ই বিরক্তিকর! তারউপর কথা না বলা কি অদ্ভুত মেয়ে রে বাবা। এত অহংকা? কথায় কথায় কোচিং শেষে সৌম্য, প্রিয়মকে বলেছিলাম কালকের ঘটনাটা ভয় ছিল বাড়িতে যদি কেউ বলে দেয়! অন্ততঃ নিজের সাপোর্টে কেউ না কেউ থাকবে, সেই আশাতেই প্রিয়ম শুনেই বলে, "তুই যাকে সাইকেলে ধাক্কা মেরেছিস, এ পাড়ার সেই নতুন বহু চর্চিত পড়ুয়া মেয়ে না হয়ে যায় না! চিন্তা নেই, পড়ার বাইরে ও হয়ত অন্য কোনো কথার নালিশ করবে না" যেমন অদ্ভূত ক্যারেক্টারতেমনই অদ্ভূত আবভাব সৌম্য ঠিকই বলে, পড়াশুনা বেশি করলে বেয়াড়া হয়ে যায় লোকেওর কোন জ্যাঠামশাই গোল্ড মেডেলিস্টসে নাকি কারুর সঙ্গে কথাই বলে নাএমনকি কোনোদিন কোনো রিলেটিভস গ্যাদারিং-এও যায়নি দিনরাত নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে! এও তেমনই হবে পাড়ায় নতুন এসেছে বলে সৌম্যর বোনেরা আলাপ জমাতে চেয়েছিলওরই বয়সী হলেও মেয়েটা নাকি ওদের দেখেও কথা তো বলেই নিউল্টে ওদের ব্যাগের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হনহন করে বাড়ির পথে হাঁটা লাগিয়েছিল কথা না বললেও সৌম্যর বোনেরা বাড়িতে এসে বলে মেয়েটা ওদের নিশ্চুপে ইনসাল্ট করে গেছেএমন ভাব পড়াশোনার বইয়ের বাইরে ও কোনো কথাই বলে না!
কাল থেকে নিম্নচাপের বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঝিম ধরে আসা বাতাসে শীতের মেজাজ মজা একেবারেই নেই। কি বিরক্ত যে লাগছে! এদিকে স্কুলের ফাংশানও এগিয়ে এল। সমীরণকাকুর দোকানে এসেছি। ফটিকচাঁদ কিনব। স্কুলের লাইব্রেরির বইটা একদম ভাজা ভাজা হয়ে গেছে। তারপর লাইনের নীচে নীচে কে আবার আন্ডারলাইন করেছে কালো কালি দিয়ে লেখাগুলো ভালো করে পড়াই যাচ্ছে নাকিন্তু সরস্বতী পুজোয় আমাদের ক্লাস সেভেন-বিকে অঙ্কন স্যার ওই নাটকই করার কথা বলেছেনআর আমার বন্ধু সৌম্য, প্রিয়মও যা দিগগজ! ওদের কাছে কোনো বই পাব এমন আশা করাটাও ভুল কাছেপিঠে কারুর কাছে খোঁজ নিয়ে পেলাম নাএদিকে নাটকের প্রধান চরিত্রে আমারই অভিনয় করার কথা! সবাই স্কুলের পরীক্ষা পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত! অগত্যা! না পড়লেও কিনতে বিশেষ করে নতুন গল্পের বই কিনতে আমার বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু মুডটা বিগড়ে গেল এই রামগরুরের ছানাকে দেখে। একে ঝিমানো আবহাওয়া তারউপর...! সারাদিন মা তাহলে এই মেয়েটাকে নিয়েই তুলনা করে? যবে থেকে ওরা পাড়ায় ঢুকেছে!  আমাদের মতো ফাঁকিবাজদের অশেষ দুর্গতি শুরু হয়েছে। বাবা-মার শাসনের কোটা আরো দশগুণ বেড়েছে। দিনে রাতে 'ওর মতো হতে পারিস না', 'কত ভালো মেয়ে,' 'শুধু বই হাতেই দেখি'... শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা।
তাই আমার মতোই, আরো চার পাঁচটা বাঁদর মিলে ঠিক করেছি এর একটা হেস্ত-নেস্ত করব। হানা দেব ওর বাড়ি। এত অহংকার কেন? এত পড়েই বা কিকরে? সব একেবারে চাক্ষুস দেখতে যাবআর হ্যাঁযদি বেশি কিছু বলে দু'চার কথা শোনাতেও পিছব নাহাজার হোক আমরা তো  পাড়ার ছোটদের দলের সিনিয়র! তবে কি বলে ঢুকব ওদের বাড়ি? অছিলা? সে একটা ঠিক বাতলে নেব।
(৩)
(ঘটনার দিন)
আমাকে নিয়ে মোট তিনজন। সৌম্য আর আমি ক্লাসমেট। প্রিয়ম পাড়াতুতো। রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে যেখানেই যাই আমরা একসাথে থাকি। এক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম ঘটেনি। প্রিয়মের ঠাকুমা, আর রাম-গরুরের দিদার খানিক আলাপ। তাই প্রিয়মের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও বাড়িতে ঢোকার খুব একটা অসুবিধা হবে বলে মনে করি নাআমি মাথা গরম করছিলাম বলে প্রিয়ম আসার পথেই বলে এনেছে রাগারাগি করার দরকার নেই শান্ত শিষ্ট ছেলের মত আমরা প্রথমে মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করবার পর ওর পড়াশোনার কথা, পছন্দের বইয়ের গল্পই নাহয় করব  তবে বই যে খুব একটা দেখার ইচ্ছে তা নয়। রাস্তায় হাতে করে বই নিয়ে ঘুরে আমাদের সর্বনাশটা কি না করলেই নয়! এটা বোঝাতেই ছোটখাটো দাদাগিরি দেখাতে তিনজন সাইকেল নিয়ে হাজির হলাম 'রায়-ভিলা'য়।
রায়-ভিলা অনেক পুরোনো আমাদের পাড়ার বাবা দাদুর আমলের বাড়ি বাড়ির শরিকরা সব এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শুনেছি এক অংশীদার দেবাঞ্জন রায় ইউ এস এতে থাকেন উনিই পাড়ার একজনকে বলে গেছেন বাড়ি দেখাশোনার জন্যউপরতলা তালা বন্ধ থাকলেও ওই দেখাশোনার লোকটিই একতলায় ভাড়া দেন! মেয়েটা এসেছে মাস চারেক হলতবে ওর নাকি বাবা-মা নেইথাকার মধ্যে এক দিদা আর তার নাতনী। মেয়েটা আমাদেরই পাশের পাড়ার শবরমতী বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ে। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু আমাদের বাবা মা-রা মাঝখান থেকে এমন শুরু করেছে...! যে মেয়েটাকে দেখলে আমাদের সবারই অস্বস্তি চুলকানি মত হয়!
আচ্ছা মেয়েটা সারাক্ষণ ঘরে একা একা থাকে কি করে? শুধু যতবারই চোখে পড়েছে হয় বই হাতে হনহন করে বাড়ির রাস্তায়নয় বইয়ের দোকানেনয়তো স্কুলের দিকে! কোনো বন্ধু নেই, কথাও বলে না! আসা যাওয়ার পথে স্কুলের কারুর সঙ্গেও ফিরতে দেখিনি আমি, আমার বন্ধুরা কেউইমাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, ভিন গ্রহের প্রাণী নাকি!
"দিদা ও দিদা?" প্রিয়ম জোরে জোরে দরজার হাতল ধরে ঠক ঠক করতে লাগল। বেশ মিনিট চারেকভিতর থেকে কোনো আওয়াজ আসছে নাবাড়িতে কি কেউ নেই? বেকার আসা হল তাহলে! ভেবেচিন্তে একটু ধাক্কা দিতেই ক্যাঁচ শব্দ করে দরজাটা খুলে মরচে ধরা অংশটা আটকে গেল মেঝের সাথে। ইশ, দরজাটার অবস্থা বাড়িটার মতোই লরঝড়ে! মরচে ধরা, রং ওঠা! তাকিয়ে আশপাশটা দেখলামনাহ, কেউ কোত্থাও নেইবাড়ির ভিতরে যাওয়া কি ঠিক হবে? আরেকটা ব্যাপার দরজাটা ফাঁক হবার সঙ্গে সঙ্গে কেমন একটা বিশ্রী পচা গন্ধ নাকে এল আমাদের ভক করে অনেকটা গন্ধ যেন আমাদের তিনজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেসৌম্য তো মুখে ওয়াক তুলে দূরে গিয়ে দাঁড়াল আমি আর প্রিয়ম মুখচাওয়া চাওয়ি করলাম। ব্যাপারটা কি? এই পচা গন্ধটা কোথা থেকে আসছে? ইঁদুর মরেছে নাকি! আর এরাই বা গেল কোথায়? দরজা তো খোলা। প্রিয়ম আরো বার দুয়েক ডাকলএবারেও কোনো সাড়া শব্দ পেলাম নাসৌম্য দেখি মুখ চেপে আরো একবার ওয়াক তুলে সোজা গেটের দিকে হাঁটা লাগিয়েছে আমি আর প্রিয়মও নাক চেপে রয়েছি পচা ভেপসে ওঠা গন্ধটা কমছে তো নাই, শিরশিরে হওয়ার সঙ্গে বেড়েই চলেছে
"পিছন দিকের দরজায় গিয়ে একবার ডাকব? ওরা ওদিকটায় থাকতে পারে! আমি একবার ঠাকুমাকে পৌঁছে দিতে সঙ্গে এসে দেখেছিলাম!" প্রিয়ম বলল।
সত্যি বলতে কি, আমারও কেমন যেন লাগছিল মেয়েটার সঙ্গেও বন্ধুত্ব করার ইচ্ছেটাও কমে আসছিল কিন্তু বন্ধুদের সামনে চট করে অনিচ্ছা দেখানোটা যায় নাওরা হাসবে টিটকিরি দেবে তাই ঠিক করি, সৌম্যকে সামনের দরজার দাঁড় করিয়ে আমি আর প্রিয়ম পিছনের দরজার দিকে যাবদেখি, প্রিয়মের কথামতন ঐদিকতায় কেউ যদি থাকে এসেই যখন পড়েছি
সন্ধ্যে নামতে বেশি দেরি নেই। শীতের ঠান্ডা আর গত দু-দিনের জলো ভাব অলি-গলিতে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব এনেছে। বছর পঞ্চাশের পুরোনো কলকাতার বেশিরভাগ বাড়িতেই বট, অশ্বত্থ উঁকি দেয় ইঁটের ফাঁক দিয়ে। রায়ভিলাও সেই ফ্রেমেই পরে। অসম্ভব বাসটে গন্ধ লেপটে রয়েছে চারপাশটায়। ঘরের ভিতর থেকে যে গন্ধটা আসছিল বাইরের আনাচে কানাচে একইরকম নোংরা গন্ধ ঘিরে আছে বাড়িটাকে এখানে মানুষ থাকে কিভাবে? ভাঙা সিমেন্টের এদিক ওদিক দিয়ে কাদা মাটি থেবড়ে পায়ে চটিতে লেগে যাচ্ছিলহড়কে পড়ে না যাই এই ভয়ে দেবে যাওয়া মাটিতে পা টিপে টিপে পিছনের কলা-গাছ ঘেঁষে  এগোলাম আমরা দুজন। আমাদের পায়ের শব্দে একটা ড্যাবা চোখের খয়েরি পাখি কোথা থেকে হুট করে বেরিয়ে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল। প্যাঁচা? শীত শীত করছিলমুখে কিছু না বললেও প্রিয়ম এগোতে এগোতে হটাৎ আমার হাতটা চেপে ধরেছিল একটু এগিয়েই বাঁ দিকে দরজা। প্রিয়ম দু'বার ডাকল। কোনো সাড়া শব্দই পেলাম না। আজব ব্যাপার! দরজা খোলা এদিকে কেউ নেই? ধুস চলে যাওয়াই ভালোআর নয়অনেক হয়েছে পিছন ফিরে এগোতে যাব প্রিয়ম আমার হাতটাকে তেমনই শক্ত করে ধরে জোরে একটা টান দিল ইশারায় দেখাল পাশের একটা জানলা জানলার অর্ধেক পাল্লা খোলা। আমরা মুখ বাড়িয়ে জানলা দিয়ে ডাকতে যাব কি! ফাঁক হওয়া জানলা দিয়ে যা দেখলাম আমাদের শরীরে সেটা দেখে আর এতটুকু ক্ষমতা ছিল না নড়বার
ঘরের যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে ঘরের বেশির ভাগটাই ঝুলে ভরা কালচে নোংরা।
কি করছে মেয়েটা?
আতঙ্কে সারা শরীর শিউরে উঠেছে আমাদের দিশেহারা হয়ে গিয়ে মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করতেও ভুলে গেছি আমরা দেখছি আলমারির পাশে লাগোয়া বিছানায় বসে মেয়েটা আধখোলা বইয়ের উপর হুমড়ি খেয়ে কিভাবে যেন বইয়ের পাতাগুলোকে জড়িয়ে ধরছে। প্রিয়ম আমার হাতটা খামচে চেপে ধরে রেখেছে। মাথাটা একটু একটু করে শরীরের মতোই অবশ হয়ে আসছিল আমার চরম ভয়ঙ্কর কিছু আমাদের চোখের সামনে ঘটে চলেছে। পা প্রায় মাটির গভীরে ডুবে যাচ্ছে
সর্বনাশ!
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আঁকশির মতো বেঁকানো লম্বা একটা জিভ। জীবনে এমন জিভ কোনোদিন দেখিনি আমি। তাকে সুরুৎ সুরুৎ করে টেনে মেয়েটা একেকটা বইয়ের পাতাকে দুমড়ে মুচড়ে গুটিয়ে নিজের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। আর পরম আদরে ক্রমশ কাছে টেনে আনছে বইয়ের মলাট। একটা, দুটো, তিনটে গোনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললেও বুঝতে পারছি বেশ মোটা একটা বই আস্তে আস্তে খচমচ খচমচ শব্দে জিভের লালার সঙ্গে সঙ্গে প্রিয় খাবারের মত দাঁতের পেষণে ঢুকে যাচ্ছে ওর গালের ভিতরে। আবছা আলোর ঘরটাতে  আমারই বয়সী একটা মেয়েকে এভাবে দেখে আমার সমস্ত শরীরের ভিতর গুলিয়ে উঠতে শুরু করল। ঘেন্নায়, ভয়ে, আতঙ্কে, চরম বিস্ময়ে দৌড়ে পালাবার শক্তিটুকুও হারালাম দুজনে। তবে কি ও সমস্ত বই এভাবেই? ভয়গুলো হামাগুড়ি দিয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে চোরা স্রোতের মতো ক্রমশ নেমে যেতে লাগল। হাত-পায়ের তলা ভিজে উঠল অজানা আশঙ্কায়। এ কি দেখছি আমরা?
কোন যুগে দাঁড়িয়ে আমরা? সত্যিটাকে বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু যা দেখছি তা যে ঘোর বাস্তব! দু'চোখে আতঙ্কের জ্বালা। সন্ধের কালো আর ঝিঁ ঝিঁ-র ডাকে বুঝতে অসুবিধা হল না ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশায় ঢেকে গেছে গোটা জায়গাটা শীত শীত জোলো একটা হাওয়া আমাদের চারপাশে ঘিরে আমাদেরই সতেজ শক্তিগুলোকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে মনে হচ্ছে, আমরা হয়ত এখান থেকে কোনদিনই আর বাড়ি ফিরতে পারব নানিশ্চল পাথরের মত জানলা ধরে দাঁড়িয়ে শুধু অস্ফুটে একটা শব্দই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল 'বইপোকা'!


(সমাপ্ত)



(প্রকাশিত, অদ্ভুতুড়ে পত্রিকা)




Comments

Popular posts from this blog

‘জায়গাটার নাম ম্যাজিক’

"মৃত্যুর ডাক"

বসন্ত আসেছিল তাদেরও মনে । গল্পের নাম - "রাজা,রানী ও সিপাহী"