স্বপ্ন
সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল বটে। কিন্তু আমার সেসব খেয়ালই ছিল না।
চোখ দুটো বুজে হাপুস হুপুস করে আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়া চটচটে মিষ্টি আমের
রস জিভ দিয়ে টেনে নিচ্ছিলাম এক্কেবারে মুখের ভিতর। কী স্বাদ।
এমন আম আমি কোনদিন খাইনি। খাওয়ার
সুযোগই হয়নি। বাবা তো সপ্তাহে একদিন বাড়ি
ফেরে। তাই প্রতিবার গরমে মায়ের কাছেই বায়না করেছি আম খাওয়ার
জন্য। মা বলে, গরম কমলে আনবে। এ সময় নাকি বাজার খুব চড়া, আমের খুব দাম, কেজি
প্রতি ৭০-৮০টাকা কখনো তারও বেশি। মনখারাপ
হয়। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে ওই পাকা বাড়ির
হরেন দাদুর বাগানের পাশ দিয়ে গেলে মিষ্টি আমের গন্ধে মন ভরপুর হয়ে যায়।
রতন, বিট্টু, পলা কতবার বলেছে, 'চল্ পিন্টু, রাতের বেলা ঢিল মেরে গোটা দশেক টুসটুসে আম পেড়ে নি।' কিন্তু আমার মন সায় দেয় না। হরেন দাদু যদি নিজে থেকে আমাদের ফল পেড়ে দিত সেকথা
আলাদা। খেতে ইচ্ছে করলেও, কখনো চুরি করব না।
কি করে জানি না আমার এই মনের কথাগুলো পড়ে ফেলেছিলেন জয়স্যার। মানে আমাদের প্রাইমারি স্কুলের একমাত্র শিক্ষক জয় সমাদ্দার।
এখন বলে নয় জয়স্যার শুধু আমারই নয়, আমাদের ক্লাসের আটজনকেই খুব ভালোবাসেন।
কি মজাই না হত যদি পচা, তিতলি, গোকুল,
রমেশ আর পাশের পাড়ার আরো পাঁচজনও আসত।
বেশ কয়েকদিন হল ওরা আর স্কুলে আসছে না। পচা
আর গোকুল নাকি বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজে লেগে গেছে কোথায়। আর বাকিরাও কেউ দোকানে বসেছে, কেউ
বাবার হেল্পার হয়ে গেছে। আমার মাও অনেকবার বলেছিল বই পড়ে
কি হবে? পেটে ভাত নেই। বাবার রাজমিস্ত্রীর কাজে হেল্পার
হয়ে যেতে। সংসারে তাহলে কিছুটা সুসার হয়।
দিনপ্রতি টাকাও পাওয়া যায় নাকি।
আমার ইচ্ছেই করেনি। এখানে থাকলে মনে হয় না আমি বাড়িতে
নেই, স্কুলে আছি। রোজ
দুপুরে আমাদের জন্য খিচুড়ি, সয়াবিন
আর সপ্তাহে ২দিন ডিম আসে ভ্যানে করে। আমার বন্ধুরা বলে এই স্কুলটা না থাকলে আমাদের দুপুরের
খাইয়াই জুটত না। রতন, পলা, বিট্টু
হয়ত ঠিক কথাই বলে। কিন্তু
জয়স্যার যখন কোলের কাছে বসিয়ে পড়ার বই ছাড়াও দেশ-বিদেশের
গল্প বলেন। রূপকথার গল্প বলেন। পুরাণের
গল্প বলেন। ভালো থাকার, ভালো হওয়ার নতুন নতুন পথের শিক্ষা দেন তখন আমার আর কিছুই মনে থাকে
না। খিদের কথাও না। মাঝে মাঝে মনে হয় স্যারকে যদি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে
পারতাম বাড়িতে। আর
আজ তো একেবারে অবাক হয়ে গেছি। দুধ ভাত আর সকলের জন্য একটা করে
হিমসাগর আম? সমস্তটাই নাকি স্যার নিজে আয়োজন
করেছেন। রান্নার যে মাসিটা খাবার দিতে আসে, ওনাকেও বারণ করে দিয়েছে।
এত আনন্দের মধ্যেও কিন্তু বেশ কয়েকদিন ধরে দেখছি স্যারের
মন খারাপ হয়ে রয়েছে। আমাদের
খাতায় লিখতে দিয়েও আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকেন জানলার দিকে। নাম
ডাকতে ভুলে যান, কখনো ছুটির ঘন্টা দিতেও ভুলে যান। পলা, বিট্টুদের বললে, ওরা
বলে 'স্যার খ্যাপা মানুষ।' সত্যিই কি স্যার খ্যাপা, পাগল?
এইতো আজও যখন খেতে বসেছি স্যার পলার
পাতে একহাতা দুধ না দিয়ে আমার পাতেই দিয়ে দিলেন। বারবার বলছিলেন, আমরা
যেন লক্ষ্মী হয়ে থাকি। এমন
মনে হচ্ছিল জয়স্যার আমাদের কিছু বলতে চাইছেন। কিন্তু
পারছেন না। অবাক লাগছিল আমার। আরো
অবাক লেগেছিল যখন ছুটির সময় স্যার বলেছিলেন, আগামীকাল যেন আমরা সবাই বাড়ির একজন অভিভাবককে
সঙ্গে নিয়ে আসি। কেমন
একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে জড়ো হচ্ছিল
লুকিয়ে থাকা ভয়।
********
ভয়ে আমার হাত কাঁপলেও একেক করে লিখছিলাম। স্যারের কথাগুলো কানে বাজছিল সবসময়।
মা বাজারে দোকান দিতে চলে যাওয়ায় আমি একাই গিয়েছিলাম স্কুলে। আর তারপরেই শুনেছিলাম..।
রতন, বিট্টুরও খারাপ লেগেছিল। কি করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
সবার সঙ্গে পায়ে পায়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। চোখ
ভরে আসছিল জলে। আর
থাকতে পারিনি। রাতেই
বসেছি খাতা পেন্সিল
নিয়ে। 'আ-কার', 'ই-কার' জোড়া দিয়ে দিয়ে বাক্যগুলো পূর্ণ করছি। চোখের সামনে ফুটে উঠছিল সেই গল্পটা। সেই বারো বছরের ছোট্ট মেয়েটার মুখ।
সাদাকো সাসকসি-কে আমি চোখে দেখিনি।
ওর মত মাইলের পর মাইল দৌড়তেও পারি না। দেখিনি
সেই জাপান দেশটাও। যেখানে বহু বছর আগে ভয়ঙ্কর পারমাণবিক
বোমা পরে ছারখার হয়ে গিয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন। কিন্তু
আজ যেন মনে হচ্ছে সাত সুমুদ্র তেরো নদীর পাড়েও এমন কেউ একজন ছিল যে আমার মতই অসহায়
হয়ে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিল। সাদাকু হাসপাতালে শুয়ে শুয়েই তৈরি করেছিল হাজার ইচ্ছেপাখি। পাখির ডানায় ডানায় প্রার্থনা করেছিল বিশ্বের শান্তি।
প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়
কাগজটায় লিখে যাচ্ছিলাম আমার ভালো লাগা, মন্দ
লাগা, রাগ, দুঃখ, অভিমান আরো কত কিছু। আর সেই কথাগুলো যা আমি কোনদিন কাউকেই বলিনি। বলিনি আমাদের ছোট্ট এই ঘুপচি টালির চালের ঘরটার বাইরে
যে একটা বিরাট পৃথিবী আছে। সেখানে জানা, অজানা এমন কিছু আছে যা আমার ছোট্ট মাথাতেও হয়ত ধরবে
না। সেসব আমি এক এক করে কুড়িয়ে বাড়িয়ে সংগ্রহ করেছি নুড়ি
পাথরের মত! হয়ত বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে আমিও
বাবার মত কাজ পারব, কাজ শিখেও যাব! কিন্তু পচা, রমেশ, তিতলির
মত হারিয়ে ফেলব অনেক কিছু!
যাকে কোনোদিন কোনোভাবেই পূরণ করা যাবে না। পলা, বিট্টুদের মত ভালো খাবার ইচ্ছে আমারও আছে।
কিন্তু তার বাইরেও আমি একটা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। হ্যাঁ সেই স্বপ্ন আমাকে দেখিয়েছে জয়স্যার। স্বপ্ন দেখিয়েছে ধূপগুড়ি বারোঘড়িয়া বটতলি স্বর্ণময়ী
প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাকে কিছুতেই আমি হারিয়ে ফেলতে পারব
না। চোখ চলে যাচ্ছিল জানলা দিয়ে অনেকটা দূর। যেখানে কালো মেঘের দলা জোট বাঁধছিল।
*******
কালো মেঘ মাথার উপরে নিয়েই ছুটে গেছিলাম ২কিলোমিটারের
পথ। ঠিক জয়স্যারের বাড়ির উঠানে।
ব্যাগ ভর্তি চিঠিগুলো জড়ো করে ধরিয়ে দিয়েছিলাম ওনার হাতে।
আমি পিন্টু দলুই জানতাম না আমাদের স্কুল আর কোনোদিন খুলবে কিনা। কেনই বা বন্ধ হয়ে গেল? জানতাম না আর কোনোদিন জয় স্যারের মুখে কঠিন আত্মবিশ্বাসের
গল্প শুনব কিনা। কিন্তু জাপানি লোককথায়
লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত সাদাকু যে স্বপ্নে ঈশ্বরের কাছে নিজের বাঁচার জন্য, পৃথিবীকে
ভালো রাখার জন্য হাজার কাগজের
সারস তৈরি করেছিল। আমিও ঠিক তেমনই হাজার ছেঁড়া পাতায়
আমার ইচ্ছেপূরণের স্বপ্নগুলো লিখেছি।
যাতে আবার করে আমি ক্লাসরুমে যেতে পারি। ছুটে এসেছি সেই মানুষটার কাছে।
যে আমাকে সৎ থাকার, সৎ মনের মানুষ হতে শিখিয়ে চলেছে।
দেখছিলাম আমার লেখা হাজার কাগজের টুকরো স্যার একটা
একটা করে খুলে চলেছেন। পড়ছেন। পড়তে পড়তে অদ্ভূতভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। বাইরে একটা সোঁ সোঁ শব্দ হচ্ছে। মনে হয় কালো মেঘগুলো কালবৈশাখীর ঝড় নিয়ে আছড়ে পড়বে
ধূপগুড়িতে। বুকের ভিতর হাপড় ওঠানামা করছিল। আর বাড়ি ফেরার শক্তি পারছিলাম না।
স্যার একটু একটু করে এগিয়ে এসে দুহাতে
আমার হাতদুটো চেপে ধরেন। আমি বেশ বুঝতে পারি, স্যারের মুঠিতে তখনও ধরা আমার এক স্বপ্নের হাজার
কাগজের টুকরো।
( সমীক্ষা অনুযায়ী জানা গেছে ২০১৯
সালে পশ্চিমবঙ্গে যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীর
সংখ্যা ২০ বা তার নীচে সরকারিভাবে সেগুলো বন্ধ করার নির্দেশ আসছে। ছাত্র-ছাত্রীদের
অন্য বিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত করার কথা হলেও অনেকক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত দূরত্বের
জন্য নতুন বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে পারছে না।
এই বাস্তব চিত্রের নিরিখে একটি কাল্পনিক স্বপ্নবুননের
গল্প।)
(সমাপ্ত)
Comments
Post a Comment